পারমাণবিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও পারমাণবিক মহাকাশযান নাই কেন?

মানব সভ্যতা আর যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস খুব সম্ভবত একইসাথে শুরু হয়েছিল। মানুষে মানুষে হানাহানি আর জবরদখলের এই সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরেই মানব সমাজে বিরাজ করছে। আর এই বিকৃত সংস্কৃতিতে পরাক্রম দেখাবার জন্য মানুষ আবিষ্কার করেছে অসংখ্য প্রযুক্তি। ঘোড়ায় টানা যুদ্ধরথ আর বিরাটকায় ধনুক থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের ৩য় প্রজন্মের ট্যাংক আর ৫ম প্রজন্মের মাল্টিরোল জেট ফাইটার ইত্যাদি সবই এই নিরন্তর প্রচেষ্টার ফল।

যুদ্ধ-বিগ্রহের ধরন আর রকমফের অনেকটা মানব সভ্যতার বদলের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি যুদ্ধের ফল নির্ণয়ে গুরুতর সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন: ট্যাংক চলে আসার পর ঘোড়ায় চড়া সেনাদলের আর কোনো দাম রইলো না।তেমনি সময়ের পরিক্রমায় পারমাণবিক শক্তির উদ্ভবের ফলে ভিবিন্ন পারমাণবিকযান তৈরী হয়েছে।

পারমাণবিক শক্তি হল শক্তির এক প্রকার রূপ। নিউক্লীয় ফিউশন বা ফিশন বিক্রিয়ার ফলে এই শক্তির উদ্ভব ঘটে। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভর হতে শক্তির রূপান্তর আইনস্টাইনের ΔE = Δmc2 শক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে ΔE=উৎপন্ন শক্তি, Δm=শক্তি উৎপন্নকারী পদার্থের ভর এবং c=আলোর গতিবেগ (শূণ্য মাধ্যমে)। ফ্রেঞ্চ পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেল সর্বপ্রথম ১৮৯৬ সালে পারমাণবিক শক্তি উদ্ভাবন করেন। তিনি অন্ধকারে ইউরেনিয়ামের পাশে রক্ষিত ফটোগ্রাফিক প্লেটের বর্ণ পরিবর্তন দেখে এই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হন। অবশ্য ১৮৯৫ সালে এই ঘটনাটির আবিষ্কার হয়।

কোন একটি ভারী মৌলের পরমাণুকে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে ভারী মৌলটি ভেংগে দুইটি হাল্কা মৌলের পরমাণুতে পরিণত হয় এবং বিপুল পরিমাণ তাপ শক্তির বিকিরন ঘটে। এই শক্তিকেই বলা হয় পরমাণু শক্তি। এই বিক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার সময় সাধারণত ৩টি নিউট্রনও উৎপন্ন হয় যা পুনরায় নতুন ৩টি বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। ফলে আরও ৯টি নিউট্রন পাওয়া যায়, যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এজন্য এই বিক্রিয়াকে বলা হয় চেইন রিঅ্যাকশন। অনিয়ন্ত্রিত পারমাণবিক বিক্রিয়া বিপুল পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে যা খুবই বিপজ্জনক।

পারমাণবিক মহাকাশযান তৈরী করা হয়েছে এবং এই ধরণের মহাকাশযান এই মূহুর্তে মহাকাশে বিচরণ করছে।পারমাণবিক রণতরী বা ডুবোজাহাজ Miniaturised Nuclear Fission Reactor ব‍্যবহার করা হয়। এগুলো মূলত পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে Heavy Element ভাঙে। এর ফলে Lighter Element পাওয়া যায় এবং এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়ে যা তাপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। এই তাপ ব‍্যবহার করে জলকে বাষ্পে পরিনত করে তার মাধ্যমে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়ে। ডুবজাহাজ এবং রণতরী এই বিদ্যুৎ ব‍্যবহার করে তাদের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিন গুলো চালায়।
তার মানে সরাসরি তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রোপালশানের জন‍্য সরাসরি ব‍্যবহার করা হয়েনা।

মঙ্গলের বুকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা রোভার পাঠিয়েছে যার নাম Curiosity। একটা ছোট গাড়ির সমান ওজনের এই রোভারকে যখন নাসা মঙ্গলে পাঠাবে বলে ঠিক করে তখন তার এক সমস্যার সম্মুখীন হয়। সূর্যের আলো যেটা মঙ্গলে পৌঁছায় তা এই রোভারের সব কাজের জন‍্য পর্যাপ্ত নয় এবং রাতে এই রোভার কাজ করতে পারবে না। তার উপর রাতে মঙ্গলে প্রবল শীত পরে যা রোভারের সব সার্কিট নষ্ট করে দিতে পারে। তাই রাতে সব কাজ বন্ধ রাখলেও একটা হিটার চালিয়ে রাখতে হবে, দিনে তার জন‍্য বিদ্যুৎ ব‍্যাটারিতে জমিয়ে রাখতে হবে। এর সঙ্গে মঙ্গলে মাঝে মাঝে ধুলোর ঝড় ওঠে যখন টানা অনেকদিন সূর্য ওঠেনা।এই জন‍্য নাসা এই রোভারের জন‍্য একটা Multi Mission Radioisotope Thermoelectric Generator ( MMRTG ) তৈরী করে। এই জেনারেটরে প্রায় 5 Kg Plutonium Dioxide ( যা Plutonium 238 এর একটা সেরামিক অবস্থা) বহন করে। এই প্লুটোনিয়াম তেজস্ক্রিয় বলে Nuclear Decay র মাধ্যমে তাপ উৎপন্ন করে। এই জেনারেটর সেই তাপকে এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ এ বদলে ফেল। যেহেতু প্লুটোনিয়াম নিজে তাপ উৎপন্ন করে এই জন‍্য আলাদা করে সার্কিটের জন‍্য হিটারের প্রয়োজন পরে না।তাই কিউরিওসিটি কিন্তু নিউক্লিয়ার স্পেসক্রাফ্ট!

তবে যদি আপনি এতে সন্তষ্ট না হন এই ভেবে যে সরাসরি যাতায়াতের জন‍্য এটা ব‍্যবহৃত হচ্ছে না, তাহলে বলি সেরকম মহাকাশযান ও আছে, কিন্তু এগুলো Advanced Experimental Phase এ আছে। এই স্পেসক্রাফ্টগুলো Lon Propulsion বলে এক ধরনের প্রযুক্তি ব‍্যবহার করে। যেখানে কিউরিওসিটির মত তাপ থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে সেই বিদ্যুৎ এর সাহায‍্যে Xenon এর মত গ‍্যাসের কনাকে Ionise করা হয়ে। এই কণাগুলো দিয়ে Thrust তৈরী করে মহাকাশযানকে চালানো হয়।

Lon Thruster, Deep Space 1 এবং New Horizon এর মত মিশনে ব‍্যবহার করা হলেও তা নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড নয়। এই বিদ্যুৎ সৌরশক্তি দিয়ে উৎপন্ন হতে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছে এই বিদ্যুৎ রেডিও আইসোটোপের মাধ্যমে উৎপন্ন করতে।

তবে এই ইঞ্জিন কেবল মাত্র মহাশূন্যে ব‍্যবহার করা যায় কারণ এটা খুব কম Thrust Generate করে। সময়ের সঙ্গে Acceleration এর মাধ্যমে এর গতি বাড়ে। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ও মধ‍্যাকর্ষণের কারণ এটা পৃথিবী বা কোন গ্রহে ব‍্যবহার করা যাবে না।

যদি এতেও আপনার শান্তি না হয় তবে আপনার কাছে পেশ করছি Project Orion।পঞ্চাশের দশকে নাসার মাথায় এক বুদ্ধি আসে তারা একটা রকেট বনাবে ঠিক করে যে বেশ কিছু পারমাণবিক বোমার সাহায্যে মহাকাশে পৌছবে। আপনি ঠিক পড়েছেন তারা রকেটের নিচে পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে এই বোমার shockwave এর সাহায্যে মহাকাশে পৌছবে। এজন‍্য তারা non nuclear explosive ব‍্যবহার করে পাচটা পরিক্ষাও করে। কিন্তু ষাটের দশকে Partial Test Ban Treaty এবং পরে Comprehensive Nuclear Test Ban Treaty র ফলে এই পথে এগোয়েনি। তাছাড়া Nuclear Fallout এরও ভয় ছিল।

কিন্তু মজার বিষয় হল এটা আজকের প্রযুক্তিতে সম্ভব এবং চাইলে এইভাবে বোমা ফাটিয়ে মহাকাশে যাওয়া যায়। শুধু তাই নয় এই রকেট এখনার যেকোনো রকেটের থেকে বেশি ভারবহন করার ক্ষমতা রাখবে।তাই আপনার মত বৈজ্ঞানিক রাও এবিষয় ভেবে যেখানে সম্ভব এই প্রযুক্তি ব‍্যবহার করছে এবং পারমাণবিক স্পেসক্রাফ্টও বানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *