পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে গর্ত করে অন্য প্রান্তে পৌছানোর চিন্তা আর সূর্যের একপাশ খনন করে অন্য পাশদিয়ে ওঠার চিন্তা করা সমান।
পৃথিবীর কেন্দ্রমন্ডলের তাপমাত্রা প্রায় ৫০০০ থেকে ৫৫০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, যেখানে সূর্য্যের উপরিভাগের তাপমাত্রা মাত্র ৫৫০৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। এখানে এখন নতুন একটা বিষয় যোগ হয়েছে, পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপমাত্রা আরো ১০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি।অর্থ্যাৎ ৬০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।এর বাইরে যতই নিচে নামতে থাকবেন ততই তাপের সাথে চাপ বাড়তে থাকবে। এর বাইরে বিভিন্য ভূ-আভন্ত্যরীন বাধা এবং অক্সিজেনের সল্পতা তো থাকবেই।
ধরে নিলাম,পৃৃৃৃথিবীর একদিক থেকে আর একদিক পর্যন্ত গর্ত করা সম্ভব হল ৷ সেই গর্তে কিছু ফেলে দিলে কি ঘটবে দেখা যাক। অভিকর্ষজ ত্বরনের স্বাভাবিক নিয়মে ফেলে দেওয়া বস্তুটির গতি বাড়তে বাড়তে তা পৃৃৃৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে সর্বোচ্চ গতি প্রাপ্ত হবে ৷
আমরা জানি,v^2=u^2+2gs এখানে ধরি পৃৃৃৃৃৃথিবীর মাঝখানে যেতে গর্তে ফেলে দেওয়া বস্তুটির যে সময় লাগবে তা হল ” t” সেকেন্ড ৷ ধরি ” u ” হল বস্তুটিকে যে গতিতে গর্তে ফেলে দেওয়া হল ৷ এক্ষেত্রে “0” বা শুন্য কারন বস্তুটিকে গর্তের মুখে ধরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে শুন্য গতিতে ৷ শুরু হয়েছে শুন্য গতি দিয়ে ৷ ” g” হল অভিকর্ষজ ত্বরন যার মান 9.8 meter per second square (প্রায়) ৷ ” s” হল মোট যাত্রাপথ, এক্ষেত্রে পৃৃৃৃথিবীর ব্যাসার্ধের সমান ৷ যার মান হল 6371 কিলোমিটার বা 6371000 মিটার (গড়) ৷এর থেকে আমরা “v ” এর মান পাই 7901.63 meter per second. অর্থাৎ বস্তূটি যখন পৃৃৃৃথিবীর কেন্দ্রে পৌছাবে তখন তার গতি হবে 7901.63 meter per second ৷
এর পর বস্তুর পৃৃৃৃথিবীর অপর প্রান্তের দিকে বস্তুটির উর্ধ গতি শুরু হবে এবং এক সময়ে পৃৃৃৃথিবীর অপর প্রান্তের গর্তের মুখে এসে বস্তুটি আবার শুন্য গতি প্রাপ্ত হবে তখন যদি বস্তুটিকে কেউ ধরে না ফেলে তাহলে আবার বস্তুটি নীচে পড়তে থাকবে এবং আবার একইভাবে পৃৃৃৃথিবীর কেন্দ্রে এসে সর্বোচ্চ গতিপ্রাপ্ত হবে ৷ এর পর আবার গতি কমতে কমতে যেখান থেকে বস্তুটিকে প্রথম ছাড়া হয়েছিল সেখানে এসে আবার শুন্য গতি প্রাপ্ত হবে ৷ যদি বস্তুটিকে কেউ ধরে না ফেলে তাহলে পৃৃৃৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চিরকাল বস্তু ওঠানামা করবে ৷
যদিও ধরি, তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। কিন্তু গর্ত খোঁড়ার কাজটি তো আর তাত্ত্বিক বিষয় নয়। তাই এই কাজটি করার ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধাগুলো কী কী হতে পারে, সেগুলো নিজের ধারনা থেকে বলার চেষ্টা করছি-
উচ্চ তাপ- পৃথিবীর কেন্দ্রে প্রায় ১২০০ কিমি ব্যাসার্ধের সর্বাধিক উত্তপ্ত গোলকীয় অঞ্চলটি অত্যধিক গরম। ওই অঞ্চলে তাপমাত্রা ৫০০০- ৫৫০০ ডিগ্রী সে. যা প্রায় সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার সমান। ওই পর্যন্ত পৌঁছানোর অনেক আগের যন্ত্রপাতি গলে যাবে।
উচ্চ চাপ- স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপে লোহা গলাতে ১৫০০ ডিগ্রী তাপমাত্রার দরকার পড়ে। কিন্তু পৃথিবীর কেন্দ্রে তার চারপাশের বস্তুর চাপ এত বেশি যে ৫০০০ ডিগ্রীতেও লোহা গলে না। সেই চাপ প্রায় ৩৬৫ গিগা প্যাসকেল, স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় চাপের (১০১ কি.প্যা.) থেকে ওই চাপ প্রায় ৩৬ লক্ষ গুন বেশি।
অভিকর্ষ বলের অভাব- আমরা আমাদের নানান কাজে এই বলকে যে কত ভাবে কাজে লাগায়, তা আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না। পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে গেলে অভিকর্ষ বল কমতে থাকবে, সেখানে খোঁড়াখুড়ি করতে গেলে এটা মাথায় রেখে প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে। কেন্দ্রের কাছাকাছি অভিকর্ষ শূন্য, যন্ত্রপাতি সব ভেসে বেড়াবে।
দূরত্ব- এখন পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে বা গবেষণার কাজে আমরা বড়জোর ৫/১০ কি.মি. গভীরে নামতে পেরেছি। সেই তুলনায় ১৩০০০ কি.মি. গভীরতা অত্যাধিক বেশি। বহুযুগ ধরে দশমিক পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে বড় সংখ্যাগুলোকে আমরা তাদের প্রকৃত মানের ছেয়ে ছোট মনে করি। ১৩০০০ যে কত বড় সংখ্যা, সেটি উপলব্ধি করতে পারবেন, যদি আপনি প্রথমে ১ থেকে ১০ গুণতে চেষ্টা করেন, তারপর আবার ১ থেকে ১৩০০০ গুনতে চেষ্টা করেন।
এরকম আরো নানান রকম বৈরী বিষয় আছে যা আমাদেরকে পৃথিবীর কেন্দ্র বরাবর বা তার আশপাশ দিয়ে গর্ত করার কাজটিকে প্রায় অসম্ভব করে রেখেছে। তাই আমরা বরং একেবারে মাঝ বরাবর না যেয়ে অনেকটা পৃষ্ঠ বরাবর যেতে পারি। সেক্ষেত্রে এসব সমস্যা এড়ানো যাবে।
এরকমই একটা চিন্তা মনে হয় ইউরোপ থেকে আমেরিকা যাওয়ার সোজা রাস্তা হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। এটি করতে পারলে অনেক কম শক্তি ব্যয়ে (ঘর্ষন না থাকলে শুধুমাত্র অভিকর্ষের প্রভাবে) এবং (তাত্ত্বিকভাবে) মাত্র ৪২ মিনিটে যেকোন দূরত্ব যাতায়াত করা সম্ভব হবে। ওরকম একটি সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে যেকোন কিছু ছেড়ে দিলে বস্তুটি ঢালু পথে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে শুরু করবে, চলতে চলতে গতি যাবে বেড়ে, আর সেই গতিতেই শেষের অর্ধেক উজান পথ পার হয়ে যাবে।
কিন্তু এরকম একটি একপেশে গর্তের মধ্যে দিয়ে চলতে গেলেও পৃথিবীর/পথের কাঠামোর সাথে তার ঘর্ষণ হবে, এখানে প্রচুর শক্তি ক্ষয় হবে। প্রচুর তাপ উৎপন্ন হবে। আর সেই তাপশক্তি কাজে লাগানোর থেকে, সেটা থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে হবে আগে।
পরিশেষে অপ্রাসংগিক হলেও, কিছু দরকারী উপলব্ধির কথা বলি।আমাদের এই পৃথিবীতে, এবং সর্বোপরি- এই পুরো মহাজগতে আমাদের জন্যে বরাদ্দ বেশি না, অত্যন্ত সীমিত।
পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরে আর নিচে মাত্র কয়েক কিলোমিটারের একটা স্বল্প পুরুত্বের চ্যাপ্টা জগতের মধ্যেই আমাদের জীবনধারনের পরিবেশ রয়েছে।অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্যে পৃথিবী পৃষ্ঠের এই বর্তমান পরিবেশ হয়ত আমাদের উপযুক্ত থাকবে। পুরো পরিবেশটা বদলে যায়, সাথে আমরাও বদলায়। তবে সেটাও একটা সীমা পর্যন্ত সম্ভব হবে।
একটা বিশাল সিস্টেম যখন ভেঙে পড়তে (মানে দ্রুত বদলে যেতে) শুরু করে, তখন সেই পরিবেশের বাচ্চা-কাচ্চাগুলো চুনোপুটির মত ধুলোয় মিশে যায়।তাই যেকোন প্রকার ঔদ্ধত্য পরিহার করে, আমাদের পরস্পরের মধ্যকার ব্যবধান ভূলে, মহাজগতের বিশালতার কাছে নিজেদের নগণ্যতা শান্তভাবে মেনে নিয়ে, সবাই মিলে একসাথে উপভোগ করাই আমাদের সকলের কর্তব্য।
ভূ-অভন্ত্যরে বিজ্ঞানের প্রচুর সীমাবদ্ধতা আছে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের প্রাইমারি তরঙ্গের ফোরকাস্ট করার মত প্রযুক্তি বের করতে পারেনি।
Leave a Reply