মহান সক্রেটিসকে যে হেমলক বিষপান করানো হয়েছিল তা ছিল হেমলক নামে এক গাছের রস। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম কনিয়াম ম্যাকুলেটাম। আইরিশরা এই গাছকে বলে ‘ডেভিল’স ব্রেড’। হেমলক দ্বিবর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। পাঁচ থেকে আট ফুট লম্বা হয়। ছোট ছোট সাদা রঙের ফুল হয়। ভেজা, স্যাঁতসেঁতে জায়গা বা নালার কাছে, নদীর ধারে এদের বেশি দেখা যায়। ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে হেমলক বেশি জন্মায়।
“হেমলক গাছ পুরোটাই বিষাক্ত। পাতা, ফুল, ফল, কাণ্ড, শিকড় সবটা জুড়েই কোনিইন নামক বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ছড়িয়ে আছে। কোনিইন হচ্ছে বিষাক্ত অ্যালকালয়েড, যা আদতে নিউরোটক্সিন জাতীয় বিষ। হেমলক উদ্ভিদ মানুষ-সহ অন্য যে কোনও প্রাণীর জীবনের জন্য হুমকি। বিশেষ করে তৃণভোজী প্রাণী ও বীজভক্ষণকারী পাখিরা হেমলকের বিষে আক্রান্ত হয়ে অনেক সময়ই মারা যায়। হেমলকের ছয় থেকে আটটি পাতায় যে পরিমাণ বিষ আছে, তা কোনও মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হলে মৃত্যু অনিবার্য!”
“কোনিইন আক্রান্ত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে ‘নিউরো-মাসকুলার জাংশন’ আটকিয়ে দেয়। যে সব তন্তু স্নায়ুর সঙ্গে পেশির সংযোগ স্থাপন করে সেগুলোকে নিউরো-মাসকুলার জাংশন বলে। নিউরো-মাসকুলার জাংশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্নায়ুর সঙ্গে পেশির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পেশিকোষ অসাড় হয়ে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যে সব পেশি যুক্ত সেগুলোও অসাড়ত্ব প্রাপ্ত হলে আক্রান্ত প্রাণীর শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। হৃদৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ না হওয়ায় আক্রান্ত প্রাণী দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।”
‘হেমলক বিষে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে।’ মহান শিক্ষক ও দার্শনিক সক্রেটিসকে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়! রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে হেমলক বিষপান করিয়ে।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছিল অ্যাথেন্সের কোর্ট। অভিযোগগুলো ছিল, অ্যাথেন্স রাষ্ট্রের দেবতাদেরকে তিনি স্বীকার করেন নি, অলৌকিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন নিজস্ব দর্শন অনুসারে, এবং শহরের তরুণ সমাজকে নিজের দর্শন দ্বারা বিপথে চালিত করেছেন। যথেষ্ট গুরুতর অভিযোগ। এমন অভিযোগ কেন আনা হয়েছিল?
বিচার ও শাস্তির পটভূমিটা জেনে নিলে সেটা বুঝতে সুবিধা হবে। সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৩৯৯ এর মাঝামাঝি। নানাবিধ টানাপোড়েনে অ্যাথেন্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন টালমাটাল। কিছুদিন আগেই অ্যাথেন্স স্পার্টার সাথে যুদ্ধে নিদারুণভাবে হেরে গেছে (পেলোপনেশিয়ানের যুদ্ধ)। অমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরে ক্ষমতাশীল দল রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু জনমত তখনকার অ্যাথেন্সের রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের ওপর ক্রমেই ভরসা হারাচ্ছিল। সক্রেটিস নিজেও ছেড়ে কথা বলছিলেন না। শাসকদের সমালোচনা করতে গিয়ে চিরশত্রু স্পার্টাদেরও রাষ্ট্রনীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি। একই সাথে তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন গণতন্ত্রের নামে অ্যাথেন্সের শাসকগোষ্ঠীর ক্রমেই দমনমূলক হয়ে ওঠার সমস্যাগুলো।
স্বাভাবিকভাবেই এটা হর্তাকর্তাদের ভাল লাগে নি। তাই তাকে উপরের বর্ণিত অপরাধে অভিযুক্ত করা হলো। শুরু হলো বিচার। যথারীতি জুরিবোর্ডের সামনেও দুর্বিনীত আচরণ করলেন তিনি। সক্রেটিসের অন্যতম শিষ্য জেনোফোনের মতে, তিনি যেন ইচ্ছা করেই জুরি আর বিচারকদের ক্ষেপিয়ে তুলছিলেন, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করছিলেন, যেন তাকে মৃত্যুদণ্ডই দেয়া হয়। হতে পারে যে তিনি নষ্টভ্রষ্ট সমাজের প্রতি একেবারেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেই ব্যবস্থাকে ক্রমাগত আঘাত করতে চাচ্ছিলেন। কোন সমাজ যখন পচে যায়, যখন ক্ষমতার মোহে অন্ধ সমাজের নেতারা যে কোন মূল্যে নিজেদের দোষ ঢাকতে চায়, যখন গণতন্ত্রের নামে শাসনযন্ত্র হয়ে ওঠে পীড়নকারী, যখন সমাজে জোর যার মুল্লুক তার নিয়ম চালু হয়, তখন একজন দার্শনিক ও শিক্ষকের হতাশার কোন সীমা থাকে না। এমন সংশোধনের ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া সমাজে আর থাকতে চান নি সক্রেটিস। দার্শনিক হিসেবে অমিত প্রজ্ঞার অধিকারী এই মানুষটির কাছে নিশ্চয়ই অসীম বেদনার ব্যাপার ছিল এটা। নিজের চোখের সামনে সভ্যতার উন্নতির শিখরে থাকা একটা রাষ্ট্রকে এভাবে ধীরে ধীরে মাস্তানির কাছে ক্ষয়ে যেতে দেখা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার না।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দিন, সক্রেটিসের হাতে তুলে দেওয়া হয় এক পেয়ালা হেমলক বিষ। বলা হয়, তাঁকে পেয়ালার বিষ পুরোটা পান করতে হবে। এক ফোঁটাও বাইরে ফেলা চলবে না। সক্রেটিস ধীরভাবে এক চুমুকে সবটুকু বিষপান করেন। এর পর সক্রেটিসকে ঘরের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, বিষ যাতে গোটা শরীরে ভাল করে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সক্রেটিস কিছুক্ষণ পায়চারী করলেন। তাঁর পা দুটি অবশ ও হৃদদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। বিষের উর্ধ্বগতির কারণে ফুসফুস বিকল হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য ক্রিটোর সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন, “Crito, we owe a c*o*c*k to Asclepius. Pay it and do not neglect it.” ক্রিটো তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, “তা অবশ্যই করা যাবে, কিন্তু আর কী কথা আছে আপনার?” সক্রেটিস এ কথার কোনও জবাব দিতে পারেননি। পক্ষাঘাতে ফুসফুস স্তব্ধ, অক্সিজেনের অভাবে অতি দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তিনি।
হেমলকের রস পান করে মহান দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যু পৃথিবীব্যাপী হেমলক বিষকে পরিচিত করে তুলেছে। মৃত্যুর আগে দর্শন বিষয়ে সক্রেটিসের শেষ কথা ছিল, “An unexamined life is not worth living”.
“শেক্সপিয়ার তার কিং লেয়ার, হ্যামলেট ও ম্যাকবেথ নাটকে হেমলক বিষের কথা উল্লেখ করেছেন। সারা পৃথিবীজুড়ে অনেক টিভি সিরিয়াল ও সিনেমার কাহিনীতে হেমলক বিষ ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজ কবি জন কিটস তার ‘de to a Nightingale’ কবিতায় হেমলকের কথা উল্লেখ করেছেন।”
Leave a Reply