আমেরিকা নয়! মানুষ চাঁদে গিয়েছে কিনা! এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। সেগুলো মেনে নেওয়া না নেওয়া, প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের উপর নির্ভর করে।মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ কি মানবসভ্যতাকে একেবারে বোকা বানাতেই ঘোষণা করেছিল নিল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিনরা চাঁদের মাটিতে নেমেছেন- ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই? সেই জুলাইয়ে কি আমাদের ‘এপ্রিল ফুল’ বানিয়েছিল নাসা?
তা হলে কি ‘অ্যাপোলো-১১’ মহাকাশযানের দুই মহাকাশচারী আর্মস্ট্রং-অলড্রিনের ‘পদচিহ্ন’ আদৌ আঁকা হয়নি চাঁদের বুকে? ঘোষণার বেশ কয়েক দিন পর মানবসভ্যতার সেই ‘প্রথম চন্দ্র-বিজয়’-এর ভিডিওটা কি ছিল তা হলে একেবারেই ‘ডক্টরড’? বানানো? হলিউডের কোনও স্টুডিওয় শ্যুট করা হয়েছিল বিশ্ববাসীকে ‘ঠকানোর সেই শতাব্দী-সেরা চিত্রনাট্য’?
আর কেউ নন, কোনও ‘কনস্পিরেসি থিয়োরিস্ট’ (যাঁরা নাসার ওই অভিযানকে বিশ্বাসই করেন না) নন। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেছে নেওয়া তাঁর বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উপদেষ্টা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডেভিড গেলার্নটারই সবার সামনে কথাটা বলে দিলেন, সোজাসাপটা। এই সে দিন, ২৪ জানুয়ারি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের এই ডাকসাইটে অধ্যাপক গেলার্নটারের বক্তব্যকে তো আর হেলাফেলা করা যায় না! তিনি যে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা! তাঁর মতামতকে নতুন মার্কিন প্রশাসন বা আমেরিকার ঘোষণা বলে মান্যতা দিলে কেনই-বা মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? অন্তত যখন ওই মন্তব্যের পর ‘আমি বলিনি’ বলে তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করেননি গেলার্নটারের মতো এক জন প্রথিতযশা অধ্যাপক। যে হোয়াইট হাউসকে আমরা অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’ বলে জানি, অধ্যাপক গেলার্নটারের ওই শোরগোল ফেলে দেওয়া মন্তব্যের পর আমেরিকার সেই ‘সাদা বাড়ি’র মুখ ‘কালো’ হয়েছে বলে অন্তত প্রকাশ্যে তো কিছু জানা যায়নি!
গত জানুয়ারিতে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞান উপদেষ্টাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘তিরিশের দশকের মধ্যেই কি আমরা (আমেরিকা) মঙ্গল গ্রহে পাঠাতে পারব মহাকাশচারীদের?’’ ওই প্রশ্নে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞান উপদেষ্টা অধ্যাপক গেলার্নটার ঝটিতি জবাব দেন, ‘‘আমরা এখনও পর্যন্ত চাঁদেই যেতে পারলাম না! তা হলে আর কী ভাবেই-বা তিরিশের দশকের মাঝামাঝি মানুষ পাঠাতে পারব মঙ্গলে? খুবই হাস্যকর ভাবনা! আমার বলা উচিত কি না জানি না, এ সব ওবামা প্রশাসনের ভাবনা ছিল। খুব হাস্যকর! খুব হাস্যকর!’’ তা হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিজ্ঞান উপদেষ্টার মুখ দিয়েই কি প্রথম সরকারি ভাবে বেরিয়ে গেল সেই সত্যটা যে, আমেরিকা ৪৮ বছর আগে গোটা বিশ্বের মানুষকে বোকা বানিয়েছিল? আর টানা ৪৮ বছর ধরে গোটা পৃথিবীর কাছে সেই ‘মিথ্যে’টাকেই ‘সত্য’ বলে বার বার প্রমাণ করে গিয়েছে আমেরিকা চাঁদে মানুষের পদার্পণের বার্ষিকী উদযাপন আর বিভিন্ন স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে?
২০ জুলাই ১৯৬৯। চাঁদের মাটিতে পা দিলেন কম্যান্ডার নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন। চাঁদের মাটিতে পা দেওয়া ‘বিশ্বের প্রথম দুই মানুষ’ হিসেবে সেই দিনই ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়েছিলেন দুই মার্কিন মহাকাশচারী। বিশ্বজোড়া অভিনন্দনে ভেসে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিছু দিন পর ‘অ্যাপোলো-১১’-এর সেই চন্দ্রাভিযানের ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ করেছিল নাসা। আর তার পরেই শুরু হয়ে যায় যাবতীয় বিতর্ক। নাসার প্রকাশিত সেই ছবিগুলি থেকে একাধিক ‘খুঁত’ বের করতে শুরু করলেন ‘কন্সপিরেসি থিওরিস্ট’রা। যাঁরা আনুষ্ঠানিক ভাবে নাসার মহাকাশ গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে চলেছেন, তাঁদেরই বলা হয়, ‘কন্সপিরেসি থিওরিস্ট’।
তাঁরাই প্রশ্ন তুললেন, নাসার এই চন্দ্রাভিযানের দাবি কি আদৌ সত্যি? নাকি পুরোটাই সাজানো? নাসা অবশ্য এই সব প্রশ্নে আদৌ কর্ণপাত করেনি। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরেই লেখা রয়েছে আর্মস্ট্রংদের নাম। কিন্তু অভিযানের সত্যতা নিয়ে খচখচানিটা সেই থেকে রয়ে গিয়েছে আজও। ‘কন্সপিরেসি থিওরিস্ট’দের পাশে মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়েছেন স্বনামধন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বিশিষ্ট জাপানি বিজ্ঞানী মিশিও কাকু। প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের পর যদি সত্যি-সত্যিই কোনও নাম উঠে আসে এই একুশ শতকে, তা হলে তিনি ‘সুপার জিনিয়াস’ কাকু।
এক মাস আগে নিউইয়র্ক সিটি কলেজের থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্সের অধ্যাপক মিশিও কাকুর অফিসে আনন্দবাজারের তরফে একটি প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল। জবাব এসেছে, ‘‘বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন অধ্যাপক কাকু। তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগত ভাবে উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্যের একটি ভিডিও পাঠানো হল। তাঁর মতামত হিসেবে ওই ভিডিওটিকে ব্যবহার করা যাবে।’’
ওই ভিডিও’য় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মিশিও কাকু ’৬৯ সালের জুলাইয়ে আর্মস্ট্রং-অলড্রিনের চাঁদে পদার্পণের ‘সত্য’কে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন।তিনি যা বলেছেন, তা একে একে নীচে তুলে দেওয়া হলঃ
১) নাসার প্রকাশিত ছবি দেখে মনে হয়েছে, চাঁদের মাটিতে পোঁতা মার্কিন পতাকা যেন হাওয়ায় নড়ছে। এমনকী মার্কিন টেলিভিশনে সেই সময়ে দেখানো ভিডিওতেও দেখা গিয়েছিল পতাকা সামান্য উড়ছে। বায়ুমণ্ডল নেই, তাই বাতাস-হীন চাঁদের মাটিতে পতাকা উড়ছে কী ভাবে? নাসার দাবি অবশ্য এই যে, দীর্ঘ দিন ভাঁজ করা অবস্থায় থাকার ফলে ছবিতে পতাকা ওই রকম দেখতে লাগছিল। একেবারেই আজগুবি কথা।
২) নাসার এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে চন্দ্রযান যে জায়গায় চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে, সেখানে অভিঘাতজনিত কোনও গর্তই তৈরিই হয়নি। এটা কখনওই হতে পারে না। ওই অসম্ভব রকমের অভিঘাতে বড় একটা গর্ত তৈরি হবেই চাঁদের পিঠে। গ্রহাণু আছড়ে পড়ায় পৃথিবীর বহু জায়গায় যেমন প্রচুর বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।
৩) চাঁদে আলোর উত্স একটাই, সূর্য। নাসার ছবি কিন্তু সে কথা বলছে না। নাসার প্রকাশিত ছবিতে বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন রকমের ছায়া দেখা গিয়েছে। যা একমাত্র সম্ভব আলোর একাধিক উত্স থাকলে। নাসার দাবি, চাঁদের বুকে সূর্যের আলো পাহাড়ে প্রতিফলিত হয়ে এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পাহাড়ের পক্ষে এই রকম ছায়া তৈরি করা সম্ভব নয়।
৪) নাসা দাবি করেছিল, ‘অ্যাপোলো-১১’ গিয়েছিল ‘ভ্যান অ্যালিয়েন রেডিয়েশন বেল্ট’ দিয়ে। ‘ভ্যান অ্যালেন রেডিয়েশন বেল্ট’ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলেই থাকে। ওই বেল্ট দিয়ে অতটা সময় ধরে গেলে মহাকাশচারীরা স্রেফ ঝলসে যেতেন। নাসা পাল্টা যুক্তি দিয়েছিল, ‘‘অ্যাপোলো-১১’ মহাকাশযান খুব কম সময় বেল্টের সংস্পর্শে এসেছিল। তাই মহাকাশচারীদের অতটা ক্ষতি হয়নি।’’ এটাও হাস্যকর!
৫) চন্দ্রাভিযানের ছবি প্রকাশের পর আরও একটি প্রশ্ন ওঠে। চন্দ্রাভিযানের যে ছবি নাসা প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গিয়েছে মহাকাশচারীর হেলমেটের কাচে একটি অস্পষ্ট ছবি ধরা পড়েছে। যেখানে দড়ি বা তারে ঝুলছে একটি বস্তু। এমন দৃশ্য নাকি ফিল্ম স্টুডিওয় দেখা যায় বলে দাবি ওই বিজ্ঞানীদের। নিম্ন মানের ছবির দোহাই দিয়ে এই অভিযোগও খারিজ করে দিয়েছে নাসা!
৬) আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ ওঠে ‘অ্যাপোলো-১১’র চন্দ্রাভিযানের ভিডিও এবং ছবি নিয়ে। সেই ছবিতে দেখা গিয়েছে পরিষ্কার আকাশ। কোনও মেঘ নেই। তবে কেন কোনও তারা দেখা যাচ্ছে না? এ ক্ষেত্রেও নাসার তরফে যুক্তি দেখানো হয়, ‘‘ছবিটি নিম্ন মানের হওয়ায় তারা স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়নি।’’ এটাও নাসার হাস্যকর যুক্তি।
৭) চন্দ্রাভিযানের যে সব ছবি প্রকাশ করেছে নাসা, তার মধ্যে একটি ছবিতে দেখা গিয়েছে চাঁদে থাকা একটি নুড়ির গায়ে ইংরেজি হরফে ‘সি’ লেখা এবং একটি ‘ক্রস’ দাগ রয়েছে। আমার (কাকু) ধারণা, স্টুডিওতে শ্যুট করার সময় ওই সংকেত ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে নাসার দাবি, ‘‘ফোটো ডেভেলপ করতে গিয়ে ওই লেখা ও দাগ ব্যবহার করা হয়েছে।’’ নাসার এই যুক্তি কাকুর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।
৮) নাসার চন্দ্রাভিযানের ছবিতে দেখা গিয়েছে, বেশ কয়েকটি ‘ক্রস’ দাগ রয়েছে। মহাকাশচারীর ক্যামেরায় স্কেলিং করার জন্য ওই ‘ক্রস’ দাগ ফুটে উঠেছে। আমার মনে হয়, ছবিটি বিকৃত করা হয়েছে।
৯) চন্দ্রাভিযানের নানা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মেশানো হয়েছে। নাসার ওই ফুটেজ ‘ডক্টরড’!
কাকুর এই বক্তব্য যেমন সম্প্রতি শোরগোল ফেলেছে বিজ্ঞানী মহলে, তেমনই হইচই ফেলে দিয়েছে বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের সাক্ষাত্কার প্রকাশিত হওয়ার পর। তিনি দাবি করেছেন, তদানীন্তন মার্কিন সরকার চন্দ্রাভিযানের শ্যুট করার প্রস্তাব দেয় তাঁকে। কুবরিকের দাবি, তিনিই নাকি সেই ফিল্ম শ্যুট করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতি খুবই জটিল বিষয়। এখানে যেকোন কিছু ই ঘটা সম্ভব। যতক্ষণ না কোন ধরণের তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ ধারণার উপর বলতে হবে।
Leave a Reply