আজ বরং আমার গল্প বলি,বন্ধুত্বের গল্প,ভালোবাসার গল্প

১১ বছর আগের কথা। দেশে ফিরে মাত্র’ই নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছি।আমার নাখাল পাড়া’র বাসা থেকে বসুন্ধরায় যেতে অনেক সময় লেগে যেত। রাস্তায় ট্র্যাফিক এতোটা’ই বেশি ছিল যে মাত্র’ই বিদেশ ফেরত আমার কোন কিছু’ই ভালো লাগছিলো না।এক সেমিস্টার শেষে জয়েন করলাম বাসার ঠিক পাঁচ মিনিট দূরত্বের আহসানুল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পায়ে হেঁটে’ই চলে যাওয়া যাচ্ছে কিংবা দরকার হলে রিকশায়।

নতুন জয়েন করেছি। বয়েসও কম। বিদেশ থেকে পড়াশুনা শেষে দেশে ফিরেছি। রক্তও খানিক গরম ওই সময়টায়।নতুন নতুন সহকর্মীদের সাথে পরিচয় হচ্ছিলো। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম- এদের প্রায় ৯০ ভাগ’ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে আসা।এদের মাঝে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাত্র’ই মাস্টার্স পাশ করে জয়েন করেছে। বয়েস কতো হবে? ২৩/২৪, এর বেশি না। কাছাকাছি বয়েস আমাদের। খুব হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মনে হয়েছিলো তাকে।

আমি আমার পরিচিত কিংবা কাছের মানুষদের সাথে যেমন প্রাণ খুলে কথা বলি কিংবা সর্বক্ষণ বক-বক করে বেড়াই; ঠিক উল্টো’টা হচ্ছে অপরিচিত মানুষজনদের সঙ্গে। খুব একটা কথা বলি না, কিংবা বললেও একদম’ই কম।তো, এক দুপুরে ইউনিভার্সিটির টিচার্স ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছি। ওই সহকর্মী আমার টেবিলের পাশে এসে বলছে
-বসতে পারি এখানে?
-নিশ্চয়।
-আপনি তো নতুন জয়েন করেছেন আমাদের এখানে। পরিচয় হয়নি সেভাবে।

আমি খুব একটা পাত্তা দিচ্ছি না। আমারও তখন বয়েস আর কতো হবে-২৪-২৫’ই হবে হয়ত। ছেলেটার কথায় কিছুটা আঞ্চলিকতার টান আছে। আবার নিজ থেকে পরিচয় হতে আসছে। তাই খুব একটা কথা বলছিলাম না! এরপর হঠাৎ দেখি সে জিজ্ঞেস করছে

-আচ্ছা, আপনার কয়টা জামা কাপড়?

প্রশ্ন শুনে আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! আমি রীতিমতো বিরক্ত হয়েছি। মাত্র’ই সুইডেন থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে গিয়েছি। এইসব শুনলে যে কারো বিরক্ত হবার কথা। আমি যেহেতু একেক সময় একেক ড্রেস পড়ে যেতাম, সে হয়ত সেটা খেয়াল করেছে। তাই হয়ত এমন প্রশ্ন করে বসেছে! যেহেতু আমি সব সময় স্পষ্টভাষী ছিলাম, তাই তাকে উল্টো জিজ্ঞেস করেছি

-আপনার তো মনে হয় একটার বেশি ড্রেস নেই। সব সময় দেখি এক’ই ড্রেস পড়ে আসেন!
আমার ওই সহকর্মী আমার এই প্রশ্নের জন্য বোধকরি প্রস্তুত ছিল না। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের মন’ই খারাপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছিলো- শুধু শুধু একটা মানুষের মন খারাপ করে দিলাম। এরপর আমি তাকে বললাম

-আপনার শেষ লেকচার কখন আজ?
-বিকেল চারটায় শেষ হবে।
আমি এরপর বললাম
-আমারও ওই সময়’ই শেষ হবে। আমরা কি আজ বিকেলে কোথাও যেতে পারি এক সঙ্গে?
সে খানিক ভেবে বললো
-ঠিক আছে।

গাড়ি ছেড়ে আমরা রিকশা নিয়ে বের হলাম বিকেলে। আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম- আপনি আমাদের গুলশান আড়ং এ নিয়ে যান।আড়ং এ গিয়ে আমি বেশ কয়েকটা ড্রেস পছন্দ করে তাকে বললাম

-এই ড্রেস গুলো যদি আমি আপনাকে গিফট করি, আপনি কি কিছু মনে করবেন?তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং বললেন

-আমি সব সময় এক ড্রেস পড়ে আসি, আপনি কি এই জন্য আমাকে এই ড্রেস গুলো উপহার দিতে চাইছেন?
আমি তাকে বললাম

-না, সে জন্য নয়। আমি বরং আমার যে ভয়ানক খারাপ লাগছে; অপরাধবোধ কাজ করছে; সে’ই খারাপ লাগার হাত থেকে বাঁচার জন্য আপনাকে ড্রেস গুলো উপহার দিতে চাইছি। আপনাকে ওই প্রশ্ন করা আমার মোটেই উচিত হয়নি। করার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়েছে- অন্যায় করে ফেলেছি।

সেদিন এই পর্যন্ত’ই। গুলশান আড়ং আমার বাসার খুব কাছেই। সেদিন হেঁটে’ই আমি বাসায় ফিরেছি।আমার এই সহকর্মী সম্পর্কে তখনও তেমন কিছু’ই জানি না। সেই অর্থে আসলে পরিচয়’ই হয়নি।শুধু এতো টুকু জানি- সে অতি জটিল বিষয় গণিতের শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেছে। এর বাইরে আর কোন কিছু জানা নেই।পরের সপ্তাহে ডিপার্টমেন্টে বেশ কয়েকজন সহকর্মী আড্ডা দিচ্ছি। তিনিও সেখানে উপস্থিত।সেখানে তুমুল বিতর্ক চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার মান ইত্যাদি নিয়ে।

সেখানে থাকা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসছে। এরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে কথা বলছে আর আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে ঢাকার বাইরের সমূদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে কথা বলার।তো, সবাই মিলে আমাকে এক রকম ঘায়েল করার মতো অবস্থা। সব চাইতে বেশি ঘায়েল করেছে গণিতের সেই সহকর্মী। যত ভাবে করা যায় আরকি।সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রীতিমত মন মেজাজ খারাপ। খানিক বাদে দেখি মোবাইলে একটা মেসেজ এসছে। মেসেজে লেখা

-কি, কেমন দিলাম আজকে?
আমি বুঝতে পারছিলাম না- কে আমাকে মেসেজ করেছে। আমি ফিরতি টেক্সটে লিখলাম
-কে, আপনি?
-আন্দাজ করুন আপনি।

আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, কে আমাকে মেসেজ করেছে, আমি আন্দাজ করতে যাবো। তো, আমি আর উত্তর দেইনি। খানিক বাদে আবার টেক্সট
-ধন্যবাদ আপনাকে সেদিনকার গিফটের জন্য।এরপর আমি বুঝতে পারালাম কে মেসেজ দিচ্ছে। উনি আমার ফোন নাম্বার কই থেকে পেলেন সেটা অবশ্য জিজ্ঞেস করা হয়নি।পরের দিন টিচার্স ক্যান্টিনে আমি’ই গিয়ে উনাকে বললাম

-আপনার সঙ্গে তো ভালো করে পরিচয়’ই হলো না।
-কি পরিচয় জানতে চান? আমার কোন পরিচয় নাই। আমি এক জামা পড়া মানুষ। এইটা আমার পরিচয়!
বুঝতে পারছিলাম, আমার উপর ক্ষোভ জমে আছে তার। তাছাড়া পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম আমার এই সহকর্মী খুব একটা গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কথায় পরিষ্কার আঞ্চলিকতার টান আছে। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কোন অঞ্চলের।সেদিন আর খুব একটা কথা হয়নি।

এর কয়েক সপ্তাহ পরে ইউনিভার্সিটিতে আন্দোলন শুরু হলো ছাত্রদের। কি একটা বিষয় নিয়ে ছাত্রদের তুমুল আন্দোলন। ক্লাস হচ্ছে না।আমি সাধারণত পায়ে হেঁটেই ইউনিভার্সিটিতে যেতাম। বাসা থেকে খুব কাছের হওয়াতে। সেদিন গাড়ি করে গিয়েছি। গাড়ি থেকে নামতে যাবো, আমার এই সহকর্মী বলছে

-ছাত্ররা আন্দোলন করছে। ক্লাস চলছে না। গিয়ে কাজ নেই ডিপার্টমেন্টে।
আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম – নাহ, এসছি যখন একটু ভেতরে যাই। হেড স্যার’কে মুখ’টা দেখিয়ে আসি।
তিনি বললেন
-আরে গিয়ে কাজ নেই। চলেন ঘুরতে বের হই।
-কই যেতে চাইছেন? গাড়িতে উঠে বসুন?

আমার ড্রাইভার রীতিমত অবাক হচ্ছে আমাকে দেখে! আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি অপরিচিতি কাউকে গাড়িতে উঠতে বলছি দেখে সে অবাক হয়েছে!
-নাহ গাড়িতে বসে কাজ নাই। বিড়ালের পেটে ঘী হজম হয় না। চলেন বাসে করে যাই।আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়। কারন আমি এক জীবনে কোন দিন ঢাকার লোকাল বাসে চড়িনি। আজীবন শুধু দূর থেকে দেখে ভেবেছি- এভাবে দৌড়ে দৌড়ে বাসে উঠা-নামা কিভাবে সম্ভব! জীবনটা তো হাতে নিয়ে চলতে হয়!

কেন যেন লোকাল বাসে চড়ার একটা ইচ্ছে আমার ছিল। তাই ভাবলাম- মন্দ হয় না।
গাড়ি ছেড়ে আমরা রিকশা করে প্রথম গেলাম ফার্মগেট। সেখান গিয়ে তিনি বললেন- এতো নাম্বার (এখন আর মনে নেই কতো নাম্বার বাসে) করে যেতে হবে।তো বাসে চড়ে আমারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। সেখানে থেকে শহীদুল্লাহ হলে। সে’ই প্রথম ঢাকার লোকাল বাসে চড়া!

কি চমৎকার পরিবেশ সেখানে। তিনি ঘুরে ঘুরে হলের প্রতিটা জায়গা আমাকে দেখাচ্ছিলেন। সেই সঙ্গে বলতে শুরু করলেন উনার পরিচিতি।সেদিন’ই জানতে পারলাম উনার সম্পর্কে।কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ছোট্ট একটা গ্রামে জন্ম। বাবা-মা সেই অর্থে কিছু করে না। তিন ভাই-বোন। তিনি’ই সবার বড়। এসএসসি ‘তে গ্রামের স্কুলে রেকর্ড পরিমাণ নাম্বার পেয়ে পাশ করায়, ঢাকার নটরডেম কলেজে পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু আর্থিক অবস্থার কারনে সেটা খুব’ই কঠিন ছিল।

শেষমেশ নারায়ণগঞ্জে এক পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বাড়িতে থেকে পড়ানোর সুযোগ পাওয়ায় নটরডেম কলেজে পড়াশুনাটা চালিয়ে নেয়া গিয়েছে। কলেজ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হন তিনি। আমি যেহেতু আজীবনই গণিতে কাঁচা ছিলাম, তাই তাকে জিজ্ঞেস করেছি -এতো সাবজেক্ট থাকতে গণিত কেন?

-আমি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা। গণিতে পড়লে অন্তত টিউশনি করে হলেও উপার্জন করা যাবে। তাছাড়া অংক আমার বরাবর’ই পছন্দের সাবজেক্ট ছিল।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে মাত্র’ই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছেন। ইউনিভার্সিটি থেকে গোল্ড মেডেলও পেয়েছেন ভালো রেজাল্টের জন্য।একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম -আমি কি আপনার গোল্ড মেডেলটা দেখতে পারি?

তিনি বললেন-আমার ছোট বোনের বিয়ের সময় মা বললেন- মেডেলটা ভেঙে একটা গয়না বানিয়ে দিতে।
এরপর তিনি নিজেই বললেন অনার্স-মাস্টার্স করে টিউশনি করেই তিনি গ্রামের বাড়ি পাকা করেছেন, ছোট বোনের বিয়ে দিয়েছেন ইত্যাদি।আমি তার কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম- এই মানুষটাকে কিনা আমি বলে বসেছি- আপনি সব সময় এক জামা পড়ে আসেন কেন!নিজের মাঝেই এক ধরনের অনুশোচনা বোধ কাজ করছিল।

গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা ছেলে স্রেফ নিজের প্রচেষ্টায় নটরডেম কলেজে পড়াশুনা করে এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে দেশের নামকরা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে তখন। হয়ত অল্প কিছুদিনের মাঝেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই জয়েন করবে। এই সময়টায় আমার এই সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয়।নিজেদের পরিচয়ের পালা শেষ হবার পর আমরা ইউনিভার্সিটির চার-পাঁচ সহকর্মী জন খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। তখন খুব হরতাল হতো দেশে।

হরতাল হলে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস হতো না। আমরা বের হয়ে যেতাম কোথাও ঘুরতে। কখনো ঢাকার আশপাশে। কখনো সদর ঘাটে গিয়ে যে কোন লঞ্চে উঠে, কখনো আবার সুন্দর বনে!আমার পরিষ্কার মনে আছে- বেশিরভাগ সময় আমার এই সহকর্মীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হতো। কারন আমাদের মাঝে সেই অর্থে কোন কিছুতে মিল নেই। উনি গণিতে পড়াশুনা করেছেন। আমি সমাজ বিজ্ঞানে! উনি গ্রাম থেকে উঠে আসা। আমি আমার জ্ঞান হওয়া অবদি গ্রামে গিয়েছি’ই বোধকরি একবার। ঢাকা শহরে’ই জন্ম, বেড়ে উঠা। উনার চিন্তা ভাবনা অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অন্যদিকে আমার চিন্তা ভাবনা সামগ্রিক। উনার রাজনৈতিক মূল্যবোধ আর আমার’টা সম্পূর্ণ’ই ভিন্ন।তাই বেশিরভাগ সময়’ই দেখা যেত আমরা তর্ক-বিতর্ক করতাম। কিন্তু কোথায় যেন একটা বুঝাপড়া ছিল।

যেই আমি কোন দিন গ্রামে যাইনি, সেই আমি’ই কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর বাজারের সেই গ্রামে গিয়ে মহা আনন্দে থেকে এসছি। আমার তো মনে হয়েছে- এর চাইতে চমৎকার গ্রাম আর হতেই পারে না! উনার বাবা-মা, ভাই-বোন, বোনের জামাই, ভাইয়ের বউ সবার সাথে পরিচয় হওয়া। আহা, কি সহজ-সরল জীবনাচরণ। দেখেই মনে হয়েছিলো- জীবন তো এমন সহজ’ই হওয়া উচিত।

এর মাঝে উনার বিসিএসে হয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পাওয়া ছেলে যেই জায়গায় পরীক্ষা দেবে সেখানে’ই চান্স পাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি ভাবছিলাম চাকরি ছেড়ে চলে গেলে তো সেই অর্থে দেখা হবে না। কোথায় না কোথায় পোস্টিং হয়! এরপর জানা গেল- কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও লেকচারার হিসেবে চাকরি হয়েছে!অর্থাৎ অনেক অপশন খোলা।আমরা এই নিয়েও আলোচনা করতাম- কি করলে ভালো হয় ইত্যাদি!

উনার কথা সোজা- চাকরি করবো, টাকা উপার্জন করবো, খেয়ে-দেয়ে মোরে যাবো!আর আমার কথা- আরও জানতে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে, সেই জ্ঞান অন্যদের ছড়িয়ে দিতে হবে। অন্যদের জন্য বাঁচতে হবে!এই নিয়েও আমরা কতো সময় তর্ক-বিতর্ক করেছি! একটা সময় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- নাহ, বিদেশে গিয়ে পিএচডি ডিগ্রী নিয়ে আসা যাক! অন্য সব কিছু পরেও চিন্তা করা যাবে।অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম- আমার চিন্তাধারার চাইতে সম্পূর্ণ বিপরীত এই মানুষটা দিন শেষে জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার বলা কথা উপর।

আমার মনে আছে, বিদেশে যাবার আগে উনাকে আমি আমাদের ঢাকার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি সাধারণত আমার বন্ধু-বান্ধব কিংবা সহকর্মীদের সেই অর্থে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতাম না। কিন্তু উনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম উনাকে।

আমার মা, যিনি কিনা সব সময় আমাদের শিখিয়ে এসছেন- কখনো কোন কিছু নিয়ে গর্ব করবে না। নিজেকে জাহির করবে না। সবাইকে সমান ভাবে দেখবে। সেই মা’কে দেখলাম উনার সঙ্গে কথা বলার সময় হেন কোন কথা নেই যেটা বলেন’নি- যাতে তিনি ছোট হন। মা বলে বসলেন

-আমার ছেলে তো গ্রামের ছেলেপেলেদের সঙ্গে একদম মিশতে পারে না! ওর তো জন্ম, বড় হওয়া সব ঢাকাতেই ! প্রতি মাসে ওর হাত খরচ’ই তো ৫০ হাজার টাকা! ইত্যাদি ইত্যাদি!আমার মায়ের এই বাড়িয়ে বলা কথা দেখে আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! সেদিন রাতে মা’কে গিয়ে বলেছি-তুমি এমন করলে কেন?মা হেসে বলেছে-তুই কখনো তোর কোন বন্ধু-বান্ধবকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিস না। একে যখন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিস, নিশ্চয় তোর খুব কাছের বন্ধু। তাই মনে হল এই ছেলেটাকে যাচাই করা যাক। আগামী এক সপ্তাহ তুই খেয়াল করে দেখবি- সে তোর সঙ্গে কেমন আচরণ করে।

যদি আগের মতোই করে, তাহলে বুঝবি, সে সত্যি’ই তোর কাছের বন্ধু। তোর পারিবারিক, আর্থিক অবস্থা কোন কিছু দেখে সে তোর বন্ধু হতে আসেনি। ঠিক এক সপ্তাহ পর ওকে আবার বাসায় নিয়ে আসবি। আমি তখন নিজে রান্না করে খাওয়াবো।
অবাক হয়ে দেখছি আমার ওই সহকর্মী পরবর্তী এক সপ্তাহ আমার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছে। উল্টো আরও বেশি সময় দিয়েছে। একবারের জন্যও কিছু বলেনি- কেন আমার মা এমন আচরণ করল।আমার মনে আছে, আমার মা যখন অসুস্থ হয়ে বিদেশে আমার এখানে এসছিলেন চিকিৎসা নিতে। তখন আমি আমার মা’কে এই দেশে থাকা দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।

এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কারন হচ্ছে- আমি এদেরকে বিশ্বাস করেছিলাম। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে নিজেকে নিজের মতো স্রেফ প্রকাশ করার একটা আকাঙ্ক্ষা এবং কিছুটা সময় কাটানোর ইচ্ছে থেকে’ই মনে হয়েছিলো এদেরকে ভালো লাগে কিংবা বিশ্বাস করা যায়। এদেরকে বন্ধু ভাবা যায়।আমার মা এদের ছোট ভাইর সঙ্গে দুইবার কথা বলেই আমাকে বলেছেন-তোর উচিত হবে না এদেরকে বিশ্বাস করা। আমার ওদেরকে ভালো মানুষ মনে হয়নি।যেই আমি জীবনভর আমার মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি, সেই আমি মাকে বলেছিলাম-মা, তুমি হয়ত বুঝতে ভুল করছ। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে কি আর মানুষ চেনা যায়। ওরা খুব একটা খারাপ ছেলে না।

এর দুই বছর পর এই দুই ছেলে আমার ভালো লাগার সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে; নিজদের পুরোপুরি ফায়দা হাসিল করে; এরপর আমাকে ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ভাবে জীবনের সব চাইতে কঠিন বিপদে ফেলে আর চিনতে পারেনি! মানুষের মতো দেখতে অমানুষদের গল্প না হয় অন্য সময় করা যাবে।আজ না হয় মানুষ হয়ে উঠার গল্প টুকু বলা যাক। বন্ধুত্বের গল্প। ভালো লাগার গল্প।তো, এক সপ্তাহ পরে উনি আমাদের বাসায় আবার গেলেন। আমার মা নিজ হাতে তার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছেন। এরপর উনাকে বললেন-আমার ছেলেকে আমারা এমন ভাবে বড় করেছি, কেউ যদি তাকে বস্তিতে নিয়ে রেখে আসে; সেখানেও সে থাকতে পারবে। আবার তুমি যদি তাকে প্রাসেদে নিয়ে রেখে আসো, সেখানেও সে থাকতে পারবে। আমার আগের দিনের কথা গুলোর জন্য ক্ষমা প্রার্থী।আমার মা এই ছেলের কাছে ক্ষমা চাইলেন।

আমি আমার ওই সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সে যে খুব অবাক হয়েছে- পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। সে তো আর আমাদের পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে জানে না।আমাদের পারিবারিক পরিবেশটাই এমন- যেখানে যে কেউ, যে কারো সমালোচনা করতে পারবে। আমরা ভাই-বোনরা এমন কিছু নেই যেটাতে নিজেরা নিজদের সমালোচনা করি না। আপনি যদি এসে আমার ভাই সম্পর্কে কিছু বলেন, যদি সেটা যুক্তিযুক্ত হয়, তাহলে আমি কোন দিন আমার ভাইয়ের পক্ষ নিতে যাবো না। ঠিক এক’ই ব্যাপার হবে ভাইয়ার ক্ষেত্রেও। আমরা এমন পরিবেশেই বড় হয়েছি। এখানে মত প্রকাশের সব রকম স্বাধীনতা আছে। সেই সাথে আছে কোন কিছু অন্ধ ভাবে মেনে না নেয়ার প্রবণতা এবং যে কিছুতে প্রশ্ন করার প্রচলন।

যা হোক, আজ না হয় বন্ধুত্বের গল্পতেই আঁটকে থাকি। তো, আমার এই সহকর্মী কোন কিছু না বলে তার মতো খেয়ে দেয়ে বিদায় নিল।আমরা এক সঙ্গেই বিদেশে এসছি পিএইচডি করতে। আজ থেকে প্রায় বছর নয়েক আগে।তিনি যেহেতু বরাবরই ভালো ছাত্র ছিলেন। চার বছরের পিএইচডি, চার বছরেই দিব্যি শেষ করে ফেললেন! আমার লেগে গেল প্রায় ছয় বছর!এর মাঝে অবশ্য আমরা দেশে গিয়েছিলাম।এইতো বছর দুয়েক আগে জুন কিংবা জুলাই মাসে হবে হয়ত। তো, আমি দেশে গিয়ে সরাসরি আমার বাসায় না গিয়ে ইচ্ছে করেই এক্সাইটমেন্টের জন্য উনাদের ভেড়ামারার গ্রামের বাড়িতে হাজির হলাম! শীত প্রধান দেশ থেকে গিয়ে পরেছি ৩৯ ডিগ্রী তাপমাত্রায়! গ্রামের ফ্যান ভালো মতো ঘুরেও না!

আমি এর মাঝেই মহা আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি! গরমে আমার খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না! এদিকে দেখি উনার নাক দিয়ে রক্ত পড়ার জোগাড়! রীতিমত নাভিশ্বাস বলা যেতে পারে!শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো এসি কিনা হবে! আমি’ই এই বুদ্ধি দিলাম- একটা এসি কিনে ফেললে সমস্যা কি! উনার ছোট ভাইকে বললাম-যাও তো একটা এসি কিনে নিয়ে আসো!আমার ওই সহকর্মী আমাকে বলে বসলেন-গ্রামে তো কারো এসি থাকে না!আমি মোটেই ছাড়ার পাত্র নই। আমি বললাম- তাতে কি? না থাকলে নাই। এসি কিনে লাগাতে কি সমস্যা আছে?

এতো দিনে আমাদের সম্পর্ক তুমি’তে নেমে এসছে। উনি আমাকে তুমি করেই বলেন। আমি অবশ্য আপনি থেকে তুমিতে নামতে পারিনি। তো, উনি আমার কথা শুনে বললেন-তোমার মতো পাগলকে, কে বলেছিল গ্রামে আসতে? ঢাকায় থাকো, ওইখানে গিয়া যা ইচ্ছে করো। এই জন্য’ই তো না জানিয়ে চলে আসছিলাম দেশে!যা হোক, সন্ধ্যার মাঝে এসি হাজির। সেই সঙ্গে মিস্ত্রী!গ্রামের একটা বাসায় দিনে দিনে এসি লাগানো হয়ে গেল! এতো টুকু হলেও হতো।উনাদের বাসায় এসি লাগানো হয়েছে; সেটা দেখে উনাদের পাশের বাসায় থাকা চাচা পরের দিন সকাল এসে বলছে-আসলেই অনেক গরম পড়েছে! আম্মা বলছিল আমাদের বাসাতেও একটা এসি লাগানো দরকার!মজার ব্যাপার হচ্ছে- পরের দিন উনাদের চাচারাও একটা এসি লাগিয়ে ফেলেছে উনাদের বাসায়!

আজীবন শুনে এসছি গ্রাম এলাকায় আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে এমন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়! সেবার নিজ চোখে দেখলাম!
গ্রামের মানুষ গুলো এতো সহজ সরল যে, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাও আবার বলে কয়ে করছে! দেখেই আমার এতো ভালো লেগেছে, আমি আমার এই সহকর্মী, যিনি এই পর্যায়ে আমার সব চাইতে কাছের বন্ধু এবং ভালো লাগার মানুষ; তাকে এবং তার মা, ভাই-বোনকে বললাম- আমি আপনাদের এখানে জমি কিনে দুইতলা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি বানাতে চাই। আমার এই গ্রামটা খুব পছন্দ হয়েছে। কি চমৎকার পরিবেশ। কি চমৎকার আশপাশের মানুষজন।এরা আমার কথা শুনেছে আর হাসছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম- এতে হাসার কি হলো? শহরে যদি অন্য এলাকার মানুষ গিয়ে বাড়ি বানাতে পারে। গ্রামে বানাতে সমস্যা কি!এরা দেখি আমার কথা শুনে ক্রমাগত হেসেই যাচ্ছে। আমার কাছের মানুষটা এইবার আমাকে বলছে- তোমার চিন্তা ভাবনা সরল। কিন্তু পৃথিবী এতো সরল না।যেহেতু আমাদের কাজ’ই হচ্ছে ঝগড়া করা, তর্ক-বিতর্ক করা; আপনাদের জানিয়ে রাখি- আমাদের এই সম্পর্ক তৈরি’ই হয়েছে ঝগড়া থেকে! তো, আমি ঘোষণা করলাম- আমার সিদ্ধান ফাইনাল!

গ্রামের সহজ সরল মানুষ গুলো আমার কথা শুনে এরপর বলেছে-আচ্ছা বানায়েন! এখন গীটারে একটা গান শুনান।
আমরা বিদেশে আমাদের শহরে আবার ফেরত এসছি। ১১ বছর কেটে গিয়েছি। নিজেদের মাঝে নানান ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। নানান সময় তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব ঠিক আগের মতো’ই আছে। ভালো লাগা হয়ত আগের চাইতেও অনেক বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে নিজেদেরকে বুঝতে পাড়ার ব্যাপারটাও আরও শক্ত হয়েছে। এখনও কোন বিপদে পড়লে তিনি’ই এসে হাজির হন। যে কোন কাজে তাকে’ই পাশে পাওয়া যায়।

গ্রামের খুব সাধারণ একটা পরিবার থেকে উঠে এসে এই মানুষটা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে; তাকে আমি বিশ্বাস করেছি। নিজেকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেছি। এই মানুষটা কখনো আমাকে, আমার পদ, পদবী, আমার আর্থিক অবস্থা কিংবা আমার পারিবারিক অবস্থা; কোন কিছুর দিকে ফিরেও তাকায়নি। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটুকু কেবল’ই নিজদের মাঝে এসে ঠেকেছে। কখনো কোন বস্তগত বিষয় সেখানে এসে নাড়া দেয়নি।আমার মা নয় বছর আগেই বলেছিলেন- এই ছেলের সাথে তুই বন্ধুত্ব করতে পারিস। সে কেবল তোকে দেখেই বন্ধুত্ব করেছে। আর কিছু না। তুই মানুষটাই তার কাছে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ।আর কিছু নয়।গ্রামের অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার পরিবার, তার বাবা-মা তাকে এই শিক্ষা টুকু দিতে পেরেছে। যেটা আমাদের শহর অঞ্চলের অনেক পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোন আজকাল আর দেয় না।

এদের কাছে সম্পর্ক মানে হচ্ছে- কোন ভাবে ফায়দা লুটে কেটে পড়া! এরা দুই, তিন, চার বার বিয়ে করেও সুখি হতে পারে না। কারন, সম্পর্কের মূল বিষয়টাই যে এদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়নি।আমরা একটা সময় দেশে ফিরব। সে হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ই শিক্ষকতা করবে। যেহেতু ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই সে পড়েছে। শত হোক গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র বলে কথা! আমারও ইচ্ছে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানো’র। জানি না, আমাকে নেবে কিনা! আমি তো আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি! এই নিয়েও আমরা দিন-রাত ঝগড়া করি! তর্ক-বিতর্ক করি।

ঝগড়া-ঝাটি, তর্ক-বিতর্ক চলতে থাক। সেই সঙ্গে বন্ধুত্বে সম্পর্ক না হয় আরও মজবুত হোক।যারা এই লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়েছেন, অনেক কৃতজ্ঞতা। লেখাটায় দেশ, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে হয়ত কিছু নেই। স্রেফ নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা লিখেছি। আমি আসলে লেখাটা আমার নিজের জন্য’ই লিখেছি। খুব ইচ্ছে ছিল সাথে কিছু ছবি জুড়ে দেবার। সেটা না হয় অন্য কোন লেখার সাথে জুড়ে দেয়া যাবে।লেখাটি আমিনুল ইসলাম স্যার এর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগ্রহ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *