মানব সভ্যতায় সাদা এবং কালো এ দুটি শব্দ যখন রঙ্গের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং হয়ে উঠেছিলো বৈষম্য ও ঔদ্ধত্যের প্রতীক তখন এরই প্রেক্ষিতে বৈষম্য ও বর্ররতার শিকার হচ্ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা৷ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শেতাঙ্গ এবং বর্ণবাদীদের অবসান ঘটে প্রায় দুই যুগ আগে। গোটা পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে বেশি বৈষম্য শিকার কাউকে পাওয়া যাবেনা।
শেতাঙ্গরা দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠতর মনে করার মনোভাব তাদের কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতনের প্রতি ঠেলে দেয়৷ অর্থাৎ তখন তাদের মনোভাব ছিলো এমন যে ‘আমাদের গায়ের রঙ্গেই আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব লিখা!’ তাই তারা কৃষ্ণাঙ্গদের বিবেচনা করতেন নিচু জাত হিসেবে৷ তবে অধর্মের বিনাশের মতোই সেই শাসন শোষনেরও অবসান ঘটে। আর তা সম্ভব হয় এক প্রবাদ পুরুষের দ্বারা৷
জ্বী প্রিয় পাঠক, বলছিলাম নেলসন ম্যান্ডেলার কথাই।
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ট্রান্সকেই অঞ্চলের থেম্বু নামক এক রাজপরিবারে জন্ম হয় রোলিহ্লাহলা ডালিভুঙ্গা অর্থাৎ আমাদের নেলসন ম্যান্ডেলার। তাঁর স্কুলের এক শিক্ষিকা নাম দেন নেলসন এবং তাঁর গোত্রীয় নাম ছিলো ম্যান্ডেলা। সেখান থেকেই তাঁর নামকরণ হয় নেলসন ম্যান্ডেলা। যদিও পরবর্তীতে তাঁর গোত্রীয় নাম ‘মাদিবা’তে তিনি বেশি পরিচিত হন।
নেলসন ম্যান্ডেলাকে জন্মের পরহ পাড়ি দিতে হয় নানা বিপদযুক্ত পথ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি লড়েছেন সত্য, ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সংগ্রাম, দেখিয়েছেন মুক্তি লাভের পথ। শ্বেত চামড়ায় গড়া বর্ণবাদের দেয়ালকে ভেঙে গুঁড়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে শিখিয়েছেন একতা, ভাতৃত্ব বোধ। আর এর মাধ্যমেই আফ্রিকার সীমানা পেড়িয়ে সমগ্র বিশ্বের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন মানবতাবাদী এক নেতা হিসেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে সাম্যের বন্ধন রটিয়ে দেওয়া মহান মানবদের মধ্যে ম্যান্ডেলার নাম চিরস্মরণীয়।
১৯৪৩-৪৪ সালে ম্যান্ডেলা যোগদান করেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) নামক সংঘটনে। এ সংঘটনের জন্ম ১৯১২ সালে। সংগঠনটির মূল কাজই ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদবিরোধী চেতনা জাগ্রত করণ এবং বৈষম্যবাদী আফ্রিকান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। তখন সেকালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল বীজটা ম্যান্ডেলার দ্বারাই সে সময় বপন হয়। ১৯৫২ সালে এএনসির ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের পূর্ণ অর্জনের অহিংস উপায়ে লড়াই। তারপর এই ৩ বছরের মধ্যেই রচিত হয় আফ্রিকান বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূলভিত্তি যা জনগণের সম্মেলন নামে পরিচিত।
তারপর ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর নেলসন ম্যান্ডেলা সহ ১৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের উপর অপবাদ চাপানো হয় রাজদ্রোহের। মামলার স্থায়িত্বকাল হয় পাঁচ বছর। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে মামলা চলতে থাকার পরও ম্যান্ডেলাসহ ১৫৫ জনের কাউকেই দোষী প্রমানিত করতে পারেনি আফ্রিকান সরকার।
১৯৬১ সালে এএনসির সশস্ত্র সংগঠন ‘উমখোন্তো উই সিযওয়ে’ (বাংলায় “দেশের বল্লম”) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্ব প্রদান করেন নেলসন ম্যান্ডেলা। সশস্ত্র বিপ্লব সাধনের জন্য প্রয়োজন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের কিছুই তাদের কাছে না থাকার কারনে গোপনে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও সমর্থন জোগাড়ে বেড়িয়ে পড়েন ম্যান্ডেলা। ম্যান্ডেলার পরিকল্পনা ছিলো আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা যা পরবর্তীতে চলতে থাকে পরিকল্পনা মোতাবেক। পাশাপাশি চলতে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার পরিকল্পনা। ম্যান্ডেলার পরিচালিত এই সশস্ত্র বিপ্লবকে মার্কিন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দেয়। এবং এর ফলাফলস্বরূপ ২০০৮ পর্যন্ত ম্যান্ডেলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
১৯৬২ সালের অগাস্টে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাহায্যে গ্রেফতার হন ম্যান্ডেলা। তার উপর আসে শ্রমিক ধর্মঘটে উসকানি দেয়া ও অবৈধভাবে দেশ ত্যাগের অভিযোগ। ফলস্বরূপ তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আর সশস্ত্র বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে ম্যান্ডেলাসহ অন্যান্য এএনসি নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে রিভোনিয়া মামলা দায়ের করা হয়। ম্যান্ডেলা অন্তর্ঘাতের দায় স্বীকার করেন এবং অন্তর্ঘাতের কারণ বর্ণনা করেন। আর তাঁর বিরুদ্ধে আনিত রাজদ্রোহের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। আফ্রিকান বর্ণবাদী সরকারের আদালতে ম্যান্ডেলাসহ এএনসি নেতা কর্মীর সকলেই দোষী সাব্যস্ত হন এবং মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাজীবনের প্রথম ১৮ বছর কাটে রবেন দ্বীপের এক কারাগারে। সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করায় ম্যান্ডেলা ও অন্যান্য নেতা কর্মীদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হয় চুনাপাথরের খনিতে। বর্ণবাদী সরকারের সকল কাজেই শ্রেনীবৈষম্যতা বিরাজ থাকায় কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের দেয়া হতো সবচেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা। এদিকে ম্যান্ডেলার কারাবরণের পর থেকেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর মুক্তির আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। দিন দিন তা বিশাল আকার ধারণ করতে থাকার কারনে এক সময় তা ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা মুভমেন্ট’ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে অধিগত হয়। তৃতীয় বিশ্বের প্রবল সমর্থন ও জনগনের প্রবল তোপের মুখে পড়ে বিশ্ব জনমত বিবেচনায় অবশেষে ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাস শেষে প্রায় বৃদ্ধাবস্থায় মুক্তি পান মানবতাবাদী বিশ্বনেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে তাঁর মুক্তির আনন্দ উদযাপনপ প্রায় ৫০ হাজার মানুষের ভীড় জমে। নেলনস ম্যান্ডেলা প্রবল গণঅভ্যর্থনা, আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জনসম্মুখে আসেন। বর্বর বর্ণবাদের অহংকার চূর্ণ হয় বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সামনে এবং মুক্তি পায় মানবতা। এই মহান নেতার জীবনী আমাদের জন্য আদর্শস্বরূপ৷ নেলসন ম্যান্ডেলা আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের মনে, মানুষের হৃদয়ে, মানুষের ভালোবাসায়।
জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নেলসন ম্যান্ডেলার পাঁচটি উক্তি দেখে নেই এক নজরেঃ(Five Quotes From Nelson Mandela):
১) আশাবাদ সম্পর্কে যেখানে একসময় থাকে বেদনার বসবাস, খেলাধুলা সেখানে করতে পারে আশাবাদের চাষ।
২) ক্ষতি সম্পর্কে কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠান আমার মর্যাদা হরণ করতে চাইলে পরাজয় তারই হবে।
৩) মানবিকতা সম্পর্কে মানুষের মৌলিক অধিকার অস্বীকার করা তার মানবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল।
৪) অর্জন সম্পর্কে পৃথিবীতে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে তুমি যতটা অর্জন করতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করতে পারবে ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
৫) সমাজ সম্পর্কে সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যারা বিশেষ কোনো পদমর্যাদার অধিকারী নন। কিন্তু সমাজের উন্নতিতে তাদের ভুমিকা এবং অবদান অনেক।
Leave a Reply