“হাইজেনবার্গের গল্প”-বিজ্ঞানের অসাধারণ আবিস্কারের অজানা কাহিনি গুলো!

আমি বিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে “হাইজেনবার্গের গল্প” টি পড়ে, গল্পগুলো আমাকে বিজ্ঞানের এক অসাধারণ জগতে উপস্থিত করেছে লেখক ।

“হাইজেনবার্গের গল্প” বইটির প্রত্যেকটি গল্প খুবই ভাল লেগেছে, তারমধ্যে ‘পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন’, ‘থ্যালিডোমাইড কেলেঙ্কারি’, ‘জঙ্গিবাদের পেছনে DNA’, ‘মশা ও HIV Virus’ এর গল্পটি আমাকে বিস্মিত করেছে। এরই সাথে এটিও জানতে পারলাম যে, পৃথিবীর সর্বপ্রথম অ্যান্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন’ আসলে ভুল করে আবিষ্কৃত হয়।এছাডাও পৃথিবীর প্রথম ভ্যাক্সিন গুটিবসন্ত থেকে কাউপক্সের ঘটনায় গড়ায় আর এর কলকাঠি নাড়ায় এডওয়ার্ড জেনার নামের এক ভদ্রলোক।

উচ্চ রক্তচাপের এবং হৃদরোগের কারণে প্রতিষেধক বানাতে যেয়ে Phase 01 trail এর কাজে ওয়েলস প্রদেশের শ্রমিকদের কাজে লাগে,এভাবে এক কাজ করতে যেয়ে আরেক ফলাফলে যৌনাঙ্গের ম্যাজিকাল ব্লু পিল তৈরী করে ফেলে ডেভিড ব্রাউন।এমনিই অনেক মজার মজার কাহিনী নিয়ে বই “হাইজেনবারগের গল্প”, হিটলারের সাথে হাইজেনবার্গের মিত্রতা,ভুল থেকে পেনিসিলিয়ামের আবিষ্কার,ডিএনএ থেকে জঙ্গিবাদ আর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাজের লোকের সাথে স্ক্যান্ডেল ২০০ বছর পর,সেটাও বর্ণিত আছে এখানে ।

আরো এরকম অনেক কাহিনি নিয়ে এই বইটা।অনেকেই বলে, মশার কামড়ের মাধ্যমে HIV ছড়ায়; মনে মনে প্রশ্ন জাগতো, মশার কামড়ের দ্বারা কি আসলেও HIV ছড়াতে পারে? অবশেষে বইটি পড়ার পর উত্তর মিলল – না, HIV তে আক্রান্ত মানুষকে দংশনকারী মশা একজন সুস্থ ব্যক্তিকে যদি কামড় দেয় তাহলে সুস্থ সবল ব্যক্তি HIV তে আক্রান্ত হবে না। তার মানে এতে করে আসলে HIV ছড়ায় না। পুরো লেখাটুকু পড়ে এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটাও জানতে পারলাম।

বেশ অবাক হয়েছি তখন, যখন জানতে পারলাম বর্তমানের ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে ‘শাঈম ওয়াইজম্যান’ নামক এক বিজ্ঞানীর হাত ছিল এবং উনার একটি ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করে ইসরাইলের মতো একটি রাষ্ট্র পর্যন্ত তৈরি করে দিল। আরোও অবাক হয়েছি এটা জেনে যে স্পার্ম তিমি (Sperm Whale) নামক এক তিমির মাথায় ৩,৬০০ কেজি ‘স্পার্মাসেটি’ তেল থাকে এবং এই তেল নিয়ে পানির ১-২ কিলোমিটার নিচে ডুব দিয়ে দিব্যি সাঁতার কেটে স্কুইড ডিনার করে আসে।

আশ্চর্য হয়েছি তবে ভয়ংকর কথা হচ্ছে আমরা লোভী মানুষরা এদেরকে মেরে ফেলছি শুধুমাত্র ঐ তেলটুকু পাবার আশায় কারণ স্পার্ম তিমির মাথার তেল যে অতি উত্তম লুব্রিকেটিং জেল ও বাতির জ্বালানি। যাই হোক, পুরো বইয়ের এই অংশগুলি পড়ে মজা পেয়েছি অনেক।

ডারউইন কী আসলেও বানরের কথা বলেছিলো? মানুষদের জন্ম-মৃত্যুর মাঝে কোন জিনিসটির সাদৃশ্য রয়েছে? কীভাবে থ্যালিডোমাইড নামক ড্রাগ সেবনকারী মায়েদের গর্ভে হাত-পা বিহীন বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়েছিল? উটপাখি কী আসলেও বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ভয় পেয়ে বালির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে রাখে? পৃথিবীর সর্বপ্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার ও যুদ্ধাস্ত্র থেকে মাইক্রোওভেন যে ভূলবশত আবিষ্কৃত হয় তার পেছনের গল্প সহ সাজানো এরকম বিজ্ঞানের আরোও মজার মজার বিষয়ে Shamir Montazid ভাইয়া খুব সুন্দরভাবে কাহিনীগুলো লিখে ফুটিয়ে তুলেছেন তার এই ‘হাইজেনবার্গ গল্প’ বইটিতে।

বাচ্চারা বড় হয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও নানা রকমের অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং এর পেছনেও কিন্তু DNA তে অবস্থিত GR নামক একটি জিন OFF থাকার উপর নির্ভর করে। আবার, মানবদেহের জন্য নিষ্ক্রিয় এমন জীবানু শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেহের বড় বড় রোগ বা ক্ষতিকর জীবানু থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এরকম গল্পে গল্পে জেনেটিক্স ও মজার মজার বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যের সমাহার এই বইটি।

আমরা হয়তো ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক নিউজ পড়ে মনে করি সায়েন্স তো অনেক সহজ। এমনকি আমাদের প্রায় সবার ধারণা যে গবেষকরা শুধু ল্যাবে বসে টেস্টটিউব নিয়ে নাড়াচাড়া করেন আর যা আবিষ্কৃত হয় তা দিনশেষে আমাদের হাতে চলে আসে। কিন্তু, সত্যি বলতে সায়েন্স আসলেই অনেক কঠিন ও সূক্ষ্ম। অনেকগুলো টেস্ট, বছরের পর বছর ফান্ডিং শেষে একটা রিসার্চ দাড় করাতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রচন্ড ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা দিতে হয়, তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। “বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে?” বইয়ের এই অংশ না পড়লে হয়তো আমি নিজেও ঠিকমতো বিজ্ঞানীদের এই কঠিন ত্যাগ স্বীকার অনুধাবন করতে পারতাম না।

বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে অর্থাৎ একজন গবেষকের কোন কোন স্টেপ মেনে গবেষণা করতে হয় তার একটা ধারণা এখানে দেওয়া আছে যেটা আমার মত গবেষণাপ্রেমীদের সাহায্য করবে।এই বইয়ের তবে বেস্ট পার্ট হলো প্রতিটা গল্পের শেষের লাইনগুলো। প্রত্যেকটি টপিকের শেষে লেখক একটি করে উক্তি জুড়ে দিয়েছেন এবং এই উক্তিগুলোর মাধ্যমে প্রত্যেকটি গল্পের সারমর্ম উঠে আসে।বোর্ড বইয়ের পাতায় আবিষ্কারের গল্পগুলো এভাবে থাকলে হয়ত কষ্ট করে কাউকে উল্টাপাল্টা পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীর নাম মুখস্থ করতে হত না।

সবশেষে বলতে চাই, বিজ্ঞানের উপর বিভিন্ন গবেষণামূলক বিষয়ে লিখা বইগুলো এমন সহজ, প্রাঞ্জল ও চমৎকার হওয়া উচিৎ। তাহলেই দেখা যাবে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পাঠ্যপুস্তক পড়ার পাশাপাশি এই ধরণের দারুন বইগুলো পড়লে বিজ্ঞান নিয়ে তাদের আগ্রহ অনেকগুণ বেড়ে যাবে। লেখকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই সেই সুদূর অক্সফোর্ড থেকে এবারের বইমেলায় এই ধরণের একটি অসাধারণ বই রচনা করার জন্য। আশা করছি সামনে আপনার লিখা আরোও চমৎকার বই পেতে যাচ্ছি। শুভকামনা ও ভালবাসা রইলো আপনার প্রতি।
জয়, বিজ্ঞানের জয়।

আমার সবথেকে ভাল লাগা প্রিয় উক্তিগুলোঃ
** Take that immortality as your payment.
**In the fields of observation, chance favors only the prepared mind.

“The first gulp from the glass of natural science will turn you into an atheist, but at the bottom of the glass God is waiting for you.”
– (Werner Heisenberg)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *