স্পোর্টস ডেস্কঃ অতীতের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব লিভারপুলের একসময় নাম ডাক ছিলো শিরোপার কারণে৷ কিন্তু সময় গড়ানোর পাশাপাশি লিভারপুল ট্রফিলেস থেকে যায় কতো বছর। মাঝপথে সাফল্য বলতে ছিলো স্টিভেন জেরার্ডের সময়ের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ট্রফি। এরপর লীগ ট্রফি দেখা পায় নি প্রায় এক যুগ ধরে। কিন্তু এখন এই লিভারপুলই যেনো বিগত ৩-৪ সিজনে ইউরোপের হট ফেভারিট ক্লাবে রুপান্তর হয়েছে আবারো। পেয়েছে লীহ শিরোপা, জিতেছে চ্যাম্পিয়নস লীগ। যেই স্বপ্নসারথিদের নিয়ে লিভারপুলের এই পথচলা তাদের মধ্যে সাদিও মানে ছিলেন একজন।
দক্ষিণ সেনেগালের পশ্চাদপদ একটি গ্রাম; গ্রামটির নাম বাম্বালি।চিকিৎসা,দরিদ্রতা,নিরক্ষরতা আর জীবনমানের অবক্ষয়- হাজার চব্বিশেক মানুষকে করেছে পর্যুদস্ত। এই পরিবেশে বেড়ে উঠছে শতশত শিশু কিশোর; প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে সোনালী সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত যারা মত্ত থাকে ফুটবল খেলায়। হোক জরাজীর্ণ রাস্তা, কিংবা এক টুকরো পরিত্যক্ত জমি- ফুটবল খেলতে পারার আনন্দে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলো এই ছেলেপেলেগুলো৷
তারা যেনো বিকেল হলেই রাস্তায় ফুটবল খেলতে নামে একসাথে। কিন্ত তাদের চাইতে একটি ছেলে ছিলো ব্যাতিক্রম।অন্য দশ- বারোটা ছেলের মতোই গড়ন, বিশেষত্বহীন চেহারা, নির্জীব নিষ্ক্রিয় চোখ! ব্যতিক্রম কেবল মনোবলে। সে তার কৈশোরের অস্তিত্ব খুঁজে পায় যেন কেবল ফুটবলেই। বড় পরিবার হওয়ায় পিতা – মাতার কষ্ট হচ্ছিলো তাকে লালন পালন করতে৷ তাই বড় হয় চাচার কাছে।
মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া সাদিও মানের বাবা মা চাইতেন তাদের ছেলে ইসলাম ধর্মের সাথে জড়িত কিছু করুক। কারণ, মানের বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম। কিন্তু পিচ্চি মানের ধ্যানে ছিলো শুধুই ফুটবল আর ফুটবল। মনে ছিলো ফুটবলার হওয়ার তীব্র নেশা। সেনেগালের রাস্তায় শুরু করে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন ইউরোপে শুধুই ফুটবলের জন্য৷ কিন্তু মানের দীর্ঘ পথটা ছিলো দূর্গম পাহাড়ি এলাকার মতো অনেক কঠিন। সেনেগালের রাস্তার ফুটবল থেকে সর্বোচ্চ তিনি খেলেছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে, খেলেছেন এবং অর্জন করেছেন ট্রফি লিভারপুলের হয়ে ও।
সেনেগালের রাজধানী ডাকারে এসেছিলো ফ্রান্সের একটি স্কাউট দল। স্কাউট দলের কাজই ছিলো সেনেগালের এমন ছেলেদের খুঁজা যারা খুব অসহায়, কিংবা যাদের আলাদা ভালো প্রতিভা আছে৷। সেই সুবাদে ফ্রান্সের এই স্কাউট টিমের নজরে আসেন সাদিও মানে।বাছাইকৃত প্রতিভাবান কিশোর ফুটবলারদের তারা ফ্রেঞ্চ লীগের জন্য প্রস্তুত করছিলো।সাদিও মানে’র ফুটবল স্কিল দেখে তারা প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলো। ব্যক্তিগতভাবে তারা মানে’কে আলাদাভাবে যত্ন নিতো।
ফ্রেঞ্চ স্কাউট দলের রিপোর্ট বলছিলো, সাদিও মানে হচ্ছে তাদের টিমের সবচেয়ে দরিদ্র এবং ঈশ্বর প্রদত্ত সবচেয়ে প্রতিভাবান ফুটবলার।জেনারেশন ফুটে প্র্যাকটিস করার সময় মানে ফরাসি স্কাউটদের সুনজরে আসেন। তাকে ফরাসি ক্লাব ‘মেজ’-এ নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র পনের বছর বয়সেই মানের পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু হয়। মেজে খুব একটা ভালো করতে পারেননি, ১৯ ম্যাচ খেলে ১ গোল করেন। আসলে এই ক্লাবটিতে তাকে মাঠে পর্যাপ্ত সাহায্য করার মতো দক্ষ খেলোয়াড় ছিল না। তাই মেজ থেকে চার মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে অস্ট্রিয়ান ক্লাব রেড বুল স্যাল্জবার্গে চলে যান।জেনারেশন ফুট’ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। এখানের ঈর্ষনীয় সাফল্যে দিনদিন তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলছিলো। ফলস্বরূপ, মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাকে সাইন করায় ফ্রেঞ্চ ক্লাব ‘মেটজ’। লীগ-২ এর বাস্তিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের ৭৫ মিনিটে ‘ক্যাভিন দিয়াজের’ পরিবর্তে মাঠে নামেন সাদিও মানে৷ সে ম্যাচে অবশ্য ১-০ গোলে হেরে যায় তার দল। সেই মৌসুমে ক্লাবের হয়ে মোট ১৯ ম্যাচ খেলেন মানে৷ ওই সিজনে লীগ-২ থেকে ‘চ্যাম্পিওনেট ন্যাশনালে’ রেলিগেডেট হয়ে যায় তার ক্লাব।
২০১২ সালের ৩১ আগস্ট, মেটজ ক্লাবের ইতিহাসের ৩য় সর্বোচ্চ ট্রান্সফার ফি’র বিনিময়ে অস্ট্রিয়ান বুন্দেসলীগার ক্লাব ‘রেডবুল সালসবার্গ’ ক্লাবে যোগ দেন সাদিও মানে। প্রথম সিজনেই ক্লাবের হয়ে ৩ টা গুরুত্বপূর্ণ হ্যাট্টিক করেন সাদিও মানে৷ সেখানে ২০১২-১৪ পর্যন্ত খেলে করেছেন ৬৩ ম্যাচে ৩১ গোল। রেডবুলের হয়ে ২য় সিজনে মানে জিতেছেন ডমেস্টিকের দুই ট্রফি। এরপর মানে নিজেই চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়ালিফাইয়ের ম্যাচের জন্য ট্রেইনিং এ যোগ দেন নি। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে মানে যোগ দেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দল সাউথআম্পটনে৷ সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মানে প্রথম সিজনে ৩২ ম্যাচে ১০গোল করেন৷২০১৫ সালের ১৬ মে তারিখে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ৬-১ গোলে জয় পায় সাউদাম্পটন।
এই ম্যাচটিকে সাদিও মানের জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাত্র দুই মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ডের মধ্যেই তিনটি গোল করেন, যেটি এখন পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিক হিসেবে অক্ষত আছে। ২০১৫-১৭ মৌসুমে বিভিন্ন ম্যাচে ১৫টি গোল করে সাউদাম্পটনের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
লিভারপুলের হয়ে সাদিও মানেঃ নিজেকে আরো বড় চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত এর জন্য ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে রেকর্ড ৩৪ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি’র বিনিময়ে লিভারপুলে চলে আসেন সাদিও মানে। লিভারপুলের সাথে তার পাঁচ বছরের চুক্তি হয়। লিভারপুলে আসার পর ২০১৭ সালে মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগে ১৩টি গোল করেন, যা তাকে ‘টিম অব দ্য ইয়ার’-এ জায়গা করে দেয়। লিভারপুলের হয়ে নিজের প্রথম ম্যাচেই গোলের দেখা পান এই ফরওয়ার্ড, গোল করেন আর্সেনালের বিপক্ষে৷ এরপর মানে মার্সিসাইড ডার্বিতে ১ গোল করেন এবং পরবর্তীতে টটেনহ্যামের বিপক্ষে ২ গোল করেন৷ ইঞ্জুরির কারণে বেশ কিছু ম্যাচ মিস করেছেন তিনি সে সিজনে৷
যদি ও লিভারপুলের হয়ে প্রথম সিজনে করেন ১৩ গোল। সে সিজনে মানে লিভারপুলের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন এবং পিএফ এর বর্ষসেরা টিমে নিজেকে জায়গা করে নেন সাদিও মানে। ২০১৭-১৮ সিজনে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে লিভারপুলের হয়ে প্রথম লীগ গোল করেন সাদি ও মানে৷ সেই সিজনে রবার্টো ফিরমিনহো, কোতিনহো, মানে জুটি ছিলো বেশ ফর্মে৷ ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ সালে সাদিও মানে লিভারপুলের হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিকের দেখা পান এই ফরওয়ার্ড। ম্যাচটি ছিলো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের রাউন্ড অফ সিক্সটিনের ম্যাচ। সে সিজনে সেনেগালের ফুটবলার হিসেবে প্রিমিয়ার লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতার শীর্ষে উঠে মানে৷ ২৬ মে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সমতাসূচক একমাত্র গোলটি করেছিলো সাদিও মানে৷
সেই গোলের মাধ্যমে এক রেকর্ড ও করে লিভারপুল। চ্যাম্পিয়ন লীগে আলাদা আলাদা ৩ খেলোয়াড় ১০+ গোলের রেকর্ড৷২২ নভেম্বর ২০১৮ সালে লিভারপুলের সাথে আবারোও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় চুক্তিবদ্ধ হন সাদিও মানে। মার্চে বার্নলির বিপক্ষে ২ গোল দেয়ার মাধ্যমে অলরেডদের হয়ে ৫০ তম গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন মানে। এরপর অলরেডদের জার্সি গায়ে নিয়মিত গোল করতে থাকেন মানে।২০ এপ্রিলে ‘পিএফএ প্লেয়ার্স প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার’ এর ৬ জনের সংক্ষিপ্ত তালিকায় টিমমেট ভ্যান ডাইকের পাশাপাশি নাম উঠে আসে সাদিও মানেরও!
পাশাপাশি লিভারপুল টিমমেট আলেক্সান্ডার আরনোল্ড, এন্ড্রু রবার্টসন এবং ভ্যান ডাইকের সাথে ‘পিএফএ প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ার’ এর জন্য মনোনিত হন সাদিও মানে। মৌসুমের শেষ ম্যাচে উলভসের বিপক্ষে ২ গোল করে সর্বমোট ২২ গোল নিয়ে মৌসুম শেষ করেন মানে। এবং সালাহ এবং পিয়েরে আবেমায়েং এর সাথে প্রিমিয়ারলীগের গোল্ডেন বুট শেয়ার করেন সাদিও মানে।
সে সিজনের ফাইনালে ও উঠে লিভারপুল৷ ইয়ুর্গন ক্লপের শিষ্যরা টানা দু’বার চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালের মঞ্চে৷ এবার প্রতিপক্ষ লন্ডনের ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পার৷ প্রথম কয়েক সেকেন্ডেই সাদিও মানের কারণে পেনাল্টি পায় লিভারপুল৷ সে রাতে ইংলিশ প্রতিপক্ষ স্পার্সদের হারিয়ে আবারো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা জয় করলো লিভারপুল, সেনেগালের সেই ছেলেটার হাতে উঠে চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা। ১৪ আগস্ট ইউয়েফা সুপার কাপের ফাইনালে চেলসির বিপক্ষে ২ গোল করেন মানে। ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র থাকায় পেনাল্টিতে গড়ায়। এবং পেনাল্টিশ্যুটআউটে ৫-৪ গোলের জয় পায় অলরেড রা৷ ম্যাচের ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন সাদিও মানে।
তার বাবা যে মসজিদের ইমাম ছিল, সে মসজিদের সংস্কারের জন্য অর্থ দিয়েছেন। তার গ্রামের দরিদ্র মানুষদের সহায়তা করেন সাধ্যমতো। শৈশবের গ্রাম বাম্বালিতে স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য আড়াই লাখ ইউরো দান করেছেন। সেনেগালের ছেলেপেলেদেরকে দিয়েছে জার্সি উপহার। যেনো তাদের কাছে নায়ক সাদিও মানে, নায়ক বললে ও যেনো ভুল হবে। সাদিও মানে তো এক মহানায়ক ।
Leave a Reply