মিশরের নাগরিগ গ্রাম থেকে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে সালাহ

স্পোর্টস ডেস্কঃ রোমা থেকে তাকে উড়িয়ে নিয়ে আসে লিভারপুল ম্যানেজমেন্ট। রোমা থেকে ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডে অল রেডদের দলে নিয়ে আসে মিশরীয় এই ফরওয়ার্ডকে৷ ডেব্যু ম্যাচেই অল রেডদের জার্সি গায়ে করেছেন গোল৷ এরপর এভারটনের বিপক্ষে এক দৃষ্টিনন্দন গোল দেয় সালাহ এবং ধারাভাষ্যকারের কন্ঠে ভাসে, ‘ Salah, The Hottest Property in the premier League right now with a red hot Liverpool finish ‘ কখনো ফিরমিনহোর সাথে, কখনো আরেক মুসলিম সতীর্থ সাদিও মানের সাথে বল বোঝাবুঝি করে কতই না গোল করেছেন এই ফরওয়ার্ড। কখনো ডি-বক্সের বাহিরদ থেকে বা পায়ে গোল, কখনো ডি-বক্সের বাহির থেকে ড্রিবলিং করে ডি-বক্সে ঢুকে গোল কিংবা কখনো ঠান্ডা মাথার পেনাল্টি স্পটের গোল৷আর গোল করে যখন সিজদা দেন তিনি এনফিল্ডে দর্শকদের সামনে তখন তাদের মন ও যেন খুশী হয়ে যায় আর ও তীব্রভাবে। শুধুই কি গোল করতে দক্ষ? গোল করার পাশাপাশি সতীর্থ খেলোয়াড়দেরকে দিয়ে গোল করানোর কাজে ও কম যান না তিনি। এনফিল্ডে থাকা প্রতিটা লিভারপুল সমর্থকের মনে জায়গা পেয়েছেন তিনি, তিনিই যেনো লিভারপুল সমর্থকদের এক বড় আশা ভরসার নাম। যাদেরকে ঘিরে অল রেড সমর্থকরা এতো স্বপ্ন দেখে, ট্রফি জয়ের স্বপ্নের দেখে সেই স্বপ্নের স্বপ্নসারথিদের মধ্যে ও তিনি একজন এবং অন্যতম৷

আরব দেশের নাগরিগ গ্রামের মফস্বল এলাকার ছেলেদের সাথে খুব সাদামাটে জীবনের পাশাপাশি তাদের সাথে খেলতো৷ এতো বছর পর তিনিই যে আরব দেশ থেকে গিয়ে ইউরোপা কাঁপাবে তা কি কেউ কল্পনা করেছিলো? কিংবা কেউ কি তা ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলো? আরব দেশের কাছে তিনি যেন এখন সম্রাট।

১৯৯২ সালের ১৫ জুন নাগরিগ গ্রামের মিসরে জন্মগ্রহণ করেন মোহামেদ সালাহ৷ ছেলেবেলা থেকেই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু জুড়ে ছিলো ফুটবল ফুটবল আর ফুটবল। বাবা মা চাইতো তাদের ছেলে করুক চাকরী৷ কিন্তু তার আগ্রহ জুড়ে ছিলো ফুটবল৷ ফুটবলের জন্য আদর্শ মানতেন জিনেদিন জিদান, রোনালদো লিমা, টট্টিদের৷ বসে থাকতেন টিভি সেটের সামনে, দেখতেন টিভিতে ফুটবল। মিশর থেকে গিয়েছেন তিনি এনফিল্ড পর্যন্ত, এভাবেই কি এতো সহজে গিয়েছেন লিভারপুলে? আজ জানবো সালাহ এর ক্লাব ক্যারিয়ার এবং লিভারপুল পর্যন্ত তার পথচলার গল্প।

ক্লাব ক্যারিয়ারঃ ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যুব ক্যারিয়ার খেলেছেন ইতিহাদ বাসইয়ুন, অথমাসুন টান্টা, আল মকাওলান ক্লাবের হয়ে। সেখানে নিজে করেছেন তার যুব ক্যারিয়ার। ২০১০-১১ সিজনে সালাহ আল মকাওলানের হয়ে পেশাদার ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেন৷ ২৫ ডিসেম্বর ২০১০ সালে তিনি পেশাদার ক্লাব ক্যারিয়ারের প্রথম গোল করেন৷ পরের বছর আর ও ম্যাচ খেলার সুযোগ পান এই ফুটবলার৷

মিশর জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলে সালাহকে দেখে এফসি বাসেলের এক এজেন্ট। সেই এজেন্ট এর কথামতো সব যেন এগিয়ে যাচ্ছিলো। এজেন্টের কথা শুনে মিশরের অনুর্ধ্ব-২৩ দলের সাথে একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচের আয়োজন করে বাসেল। সে ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমে জোড়া গোল করেন সালাহ। এরপর যেন রুপকথার পর সুযোগ আসে বাসেলের হয়ে খেলার৷সুইজারল্যান্ডের ফুটবল লিগ মাতানো সালাহর দিকে মনোযোগ দেয় ইংলিশ জায়ান্ট চেলসি।ঠিক একই চিত্রনাট্যে, ইউরোপিয়ান কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসির বিরুদ্ধে অসাধারণ পার্ফমেন্স দেখিয়ে চেলসিকে নিজেকে সাইন করাতে যেন এক প্রকার বাধ্য করেন সালাহ।

২০১৪ সালে চেলসির হয়ে সাইন করার পর উড়তে থাকা সালাহর ক্যারিয়ারে দেখা দেয় দু:সময়ের ঘনঘটা।চেলসির হয়ে দশ ম্যাচে মাত্র দুই গোল করে বাদ পড়ে যান চেলসির তৎকালীন কোচ জোসে মৌরিনহোর গুড বুক থেকে।পরের সিজনে ইতালিয়ান ক্লাব ফিরোন্টিনার হয়ে ধারে খেলেন তিনি।সিরিআতে ভালো পার্ফমেন্সের জন্য সালাহ কে দলে ভেড়ায় এফসি রোমা। রোমার হয়ে দুর্দান্ত ধারাবাহিকভাবে পারফরম্যান্স করেছেন সালাহ৷ নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন রোমার হয়ে৷ রোমাতে প্রথম সিজনে লোনে গিয়ে রোমার টপ গোল স্কোরার বনে যান তিনি, সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে করেন ১৫ গোল৷ সিরিয়াতে রোমার হয়ে ৩৪ ম্যাচে করেছিলেন ১৪ গোল৷ লোনে এক বছর পারফরম্যান্স করার পরের বছরই রোমার সাথে চুক্তি হয়ে যায় তার৷ ২০১৬-১৭ সিজনে রোমার হয়ে ৩১ ম্যাচে ১৫ গোল করেন এই ফরওয়ার্ড। এরপরের সিজনেই যেন বদলে যান তিনি৷ ফর্মে থাকা সালাহকে দলে ভিড়িয়ে চমক এনে দেন ইয়ুর্গন ক্লপ৷

লিভারপুলের হয়ে মোহামেদ সালাহ : ২০১৭ সালে লিভারপুলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন সালাহ। রোমা ছেড়ে এবার ইংলিশ জায়ান্ট লিভারপুলে তিনি। প্রথম মিশরীয় ফুটবলার হিসেবে লিভারপুলের জার্সি উঠে সালাহ এর গায়ে। লিভারপুলের জার্সিতে নিজের প্রথম ম্যাচেই পান গোলের দেখা তিনি৷ এরপর প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই পাচ্ছিলেন গোল করছিলেন এসিস্ট। ২০১৮ সালে সালাহ ওয়াটফোর্ডের বিপক্ষে একাই করেন চার গোল৷ সে ম্যাচেই তিনি লিভারপুলের জার্সিতে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। রেকর্ড ভেঙ্গে তিনি নিজের প্রথম ডেব্যু সিজনেই করেন ৩৬ গোল৷ সি সিজনের চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়াটার ফাইনাল, সেমি ফাইনালের ম্যাচগুলোতে গোল এবং এসিস্ট করে দলকে নিয়ে গিয়েছিলো ১১ বছর পর ফাইনালের মঞ্চে। হয়েছেন পিএফএ প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার এবং জিতেছেন প্রিমিয়ার লীগের গোল্ডেন বুট । সেবার চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে অনেক স্বপ্ন নিয়ে নামে লিভারপুল কিন্তু ম্যাচের মাত্র ৩০ মিনিটে ইঞ্জুরি নিয়ে মাঠ ছাড়েন এই মিশরীয় ফুটবলার। সেবার ফাইনালে ৩-১ এ রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হারে লিভারপুল।

গত সিজনে কাঁধের চোটের জন্য ফাইনালের মাঝপথেই চোখের জলে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল লিভারপুলের সালাহকে। রিয়াল মাদ্রিদের কাছে খেতাব হারানোর যন্ত্রণা তিনি ভুলে গেলেন এবার। তাঁর পেনাল্টিতে করা গোলেই লিভারপুল ম্যাচের ২ মিনিটের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল। মিশরের প্রথম ফুটবলার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের গোল করার নজির গড়েছিলেন সালাহ। এক মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের মাথায় তাঁর করা গোলটিই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে দ্বিতীয় দ্রুততম গোল হিসেবে ইতিহাস লিখেছিল।

ওয়ান্ডো মেট্রোপলিটানো স্টেডিয়ামে সে রাতে ২০ হাজার লিভারপুল সমর্থক গলা ফাটিয়েছিলেন সালাহর জন্য। মিশরের রাজার জন্য গান বেঁধেছিলেন তাঁরা। “If he scores another few, Then I’ll be Muslim too… If he’s good enough for you, He’s good enough for me, Then sitting in a mosque, is where I wanna be Mo Salah-la-la-la-lah! Mo Salah-la-la-la-lah!” বাংলায় যার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ”সালাহ যদি আরো গোল করে তাহলে আমিও মুসলিম হয়ে যাব। ও যদি তোমার জন্য যথেষ্ট ভাল হয়, তাহলে আমার জন্যও ততটাই ভাল। এরপর একটা মসজিদে বসে আমিও মো সালাহ হতে চাইব।” যাঁরা সালাহর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন, তাঁরা কেউ সালাহর গোলের পর স্ট্যান্ডে বসেননি। দাঁড়িয়ে দুলছিলেন।

সাইমন কার্টিস, ৩৫ বছরের লিভারপুলের আজী সুরে গলা মিলিয়ে বলছেন, “ও অসাধারণ, ওকে কোনওদিন লিভারপুলে বিয়ার কিনতে হবে না। এই পরিবেশে একজন মুসলিমের পক্ষে থাকাটা সহজ নয়। কিন্তু সালাহ ধারণাটাই বদলে দিয়েছে। গানের শেষ লাইনটা সেই তাৎপর্য বহন করছে। ও সব বাঁধা পেরিয়ে আমাদের গান গাওয়ার কারণ হয়ে গিয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওর জন্য সেলিব্রেট করতে পেরেছি।” লিভারপুলের আরেক ফ্যান টেডি মে। এখন তাঁর বয়স ৪৪। চার বছর বয়স থেকেই লিভারপুলের সমর্থক তিনি। বলছেন, “অতীতেও লিভারপুলে মুসলিম প্লেয়ার খেলেছে। কিন্তু ও সবার থেকে আলদা। একজন মেগা স্টার হয়েও অসম্ভব মাটির মানুষ। পরিবারের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে। মসজিদে যায়। আর পাঁচজনের মতোই সালাহ। ” ২০১৮ সালে এভারটনের বিপক্ষে করা গোলটা পুসকাস এওয়ার্ড জিতে নেয়। লিভারপুলের হয়ে দ্রুততম ফুটবলার হিসেবে ৬৫ ম্যাচে ৫০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। লিভারপুলের হয়ে প্রিমিয়ার লীগ, চ্যাম্পিয়নস লীগ, সুপার কাপ, ফিফা ক্লাভ ওয়ার্ল্ড কাপ জয় করেছেন তিনি৷

জাতীয় দলকে একাই নিয়ে গিয়েছিলেন ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের মঞ্চে৷ রাশিয়া বিশ্বকাপে ও গোলের দেখা পেয়েছেন তিনি৷ জাতীয় দলের হয়ে ৬৮ ম্যাচে ৪৩ গোল করেছেন তিনি৷ বিশ্বকাপ ছাড়া ও আফ্রিকান কাপে ও দলকে দিয়েছেন সাফল্য তিনি৷ সালাহ সবসময় দেশের জন্য কিছু করতে চাইতেন। ফুটবল দিয়েই করতে চাইতেন। কোচরাও সেটা জানত। তাই হামদির মতন সবাই তাকে বলত, ‘তুমি যত অনুশীলন করবে, তত বেশি ভাল করতে পারবে। যত ভাল করবে, তত বেশি উপার্জন করতে পারবে।’তাইতো দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইংল্যান্ডের ক্লাব লিভারপুলের হয়ে কাপাচ্ছেন মাঠ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *