“ফুকুশিমা পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র”- ঘটে যাওয়া এক পারমাণবিক বিপর্যয়!

ফুকুশিমা দাইইচি পরমাণু দুর্ঘটনা হল ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে জাপানে ঘটা বৃহৎ পরমাণবিক বিপর্যয়। ওকুমায় অবস্থিত ফুকুশিমা দাইইচি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রর ছয়টি চুল্লীর (রিয়্যাক্টরের) দু’টিতে বিস্ফোরণ ঘটে, এর পরেই আরও তিনটি রিয়্যাক্টরের আংশিক গলন ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। নিকটবর্তী অঞ্চলের বহু বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফুকুশিমা দাইইচি পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র মোট ৩.৫ বর্গ কিলোমিটার (৮৬০ একর) এলাকায নিয়ে গঠিত, যা জাপানের ফুকুশিমা জেলার ফুটাদা ও ওকুমা শহরে অবস্থিত।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আশেপাশে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ মিলিসিভার্টে পৌঁছে যায়। সমগ্র জাপানে বিকিরণের মাত্রায় লক্ষ্যণীয় বিবর্ধন আসে।১১ই মার্চ, ২০১১ সালে অধিকর্তারা ৭ মাত্রার আন্তর্জাতিক পারমাণবিক ঘটনার মাপকাটি ফুকুশিমা দাই-ইচি পরমাণু দুর্ঘটনাকে সর্বোচ্চ ৭ মাত্রা দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। ১৯৮৬ খ্রিঃ চের্নোবিল দুর্ঘটনার পর এত বড় পারমাণবিক দুর্ঘটনা কোথাও হয়নি। অনেক মাস পরে ঘটনাস্থলের ২০ কিমি ব্যাসার্ধের অন্তর্বর্তী অঞ্চলকে জনবসতি স্থাপনের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করা হয়, যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অতি নিকটস্থ অঞ্চল তখনও বিপজ্জনক ছিল।

১১ মার্চ ২০১১। দিন চলছে দিনের মতনই। ফুকুশিমার রিএক্টরর ও চলছে ভালোভাবেই। ৬ টা রিয়েক্টরের ৪ টা চলছে,বিদ্যুত তৈরি করছে।হাজারো ইঞ্জিনিয়ার আর লোক তাদের শিফটে কাজ করছেন।

মাসাও ইউশিডা। ফকুশিমা দাইইচি পাওয়ার প্লান্টের ম্যানেজার। দুপুরের লাঞ্চ শেষ, পাওয়ার প্লান্ট একবার চক্কর দিয়ে আসাও শেষ। সব প্লান মোতাবেক ঠিক ঠাক চলছে। সুপারভাইজার কে সব বুঝিয়েও দেয়া হয়েছে।তাহলে এখন একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। সামনে থাকা বইটি নিয়ে পড়া শুরু করলেন।বেশ অনেকবছরের অভ্যাস এটি। বই না পড়লে তার ভালোই লাগে না।

দুপুর ৩.১০-৩.১৫ এর মাঝামাঝি বা আশেপাশে। হটাৎ তার হাতের বইটা কাপতে শুরু করল। না বয়সের কারণে তার হাত কাপছে না। রিখটার স্কেলে 9 মাত্রার ভূমিকম্প। দিলেন দৌড়। তবে সতর্ক সংকেত চালু করতে ভুলে যান নি। সব লোক সাবধানতা অবলম্বন করল। কিছুক্ষন পর সব ঠিক। বের হয়ে আসলেন তিনি সুপারভাইজার দের নিয়ে জরুরী মিটিং ডাকলেন।সুপারভাইজাররা রিপোর্ট করে জানাল কোথাও কোন সমস্যা নেই তবে রিএক্টর ৬ এ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু ঐ রি এক্টর তো চালু নেই,তাই প্যারাও নেই। টোকিও পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউট কোম্পানীর কাছে একটা খবর পাঠিয়ে দিলেন। সুপারভাইজারদের কেও পাঠিয়ে দিলেন যার যার কর্মস্থলে। সিটে এসে বসলেন তবে তার মধ্যে শান্তি নেই।

হটাৎ সুনামি সতর্কতা জারি হল। ভয়ে কেপে উঠলেন ইউশিডা।সমুদ্রের পাশেই যে তার পাওয়ার প্লান্ট।তাৎক্ষনিক ভাবে জরুরি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে সব পাওয়ার প্লান্ট রিএকটর বন্ধ করে দিতে বলা হল। কিন্তু বড্ড দেরি হয়েছে।নিউক্লিয়ার প্লান্ট অফ করতে যে সময়টা লাগে,প্রকৃতি সে সময়টা দেয়নি।

৩:৩৬। আধা ঘন্টার ও কম সময়ে সুনামি আঘাত হানল। যদিও বা অনেক লোককে বের করে নেয়া হয়েছে,২০০০ এর মত লোক থেকে গেল প্লান্টে।তারা জানেন,তারা পালালে আরেকটি চেরনোবিলের জন্ম হবে।

১৭ মিটার।কমপক্ষে ৬ তালার সমান উচু ঢেউ এসে আঘাত হানল জাপানে।প্রচুর ধ্বংসযোগ্য চালালো। নিজের পরিবারের খোজ নেয়ার কথা মাথায় এলেও তিনি আগে পাওয়ার প্লান্ট টার খোজ নিতে চাইলেন।

ডুবে গেছে পাওয়ার প্লান্ট।!! পানির নিচে! ম্যানেজারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ২০০০ জন কাজ করছিল,তারা কোথায়? পানিতে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে! তার চাইতেও বড় কথা, এই স্থানে উদ্ধার কাজ চালাতে আসবে কে? এখানে আসা মানেই যে নির্ঘাত মৃত্যুর কাছাকাছি যাওয়া!

জাপানে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে সুনামিতে।আস্ত ট্রেন হারিয়ে গিয়েছে যাত্রীসহ! বহু ঘর বাড়ি ভেঙেছে। এর এইদিকে টোকিং পাওয়ার এর কর্মকর্তাগন ছুটছেন দেশকে বাচাতে। স্বেচ্ছাসেবক ডাকা হল। ওই পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজে যাওয়া মৃত্যুর মুখোমুখি। জাপান চায় না কাউকে জোর করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে। তাই স্বেচ্ছাসেবক ডাকা হল। যদি কেউ দেশের জন্য স্বেচ্ছায় উদ্ধারকাজে অংশগ্রহন করতে চান তাহলে আসুন।জাপান আপনাদের মত বীর খুজছে। আমার বা আপনার মত বাঙালী হয়ে কেউ তখন ঘরের কোনায় লুকিয়ে থেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়নি। বের হয়ে চলে গিয়েছে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহন করার জন্য।পরিবারের সদস্যরা সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে। একজন ছেলে( নাম উল্লেখ করে বাকিদের খাটো করব না) তার বাবা ওই প্লান্টে কাজ করতেন। দুর্ঘটনায় পর থেকে তার খবর নেই। ছেলে বের হয়ে আসল দেশকে রক্ষার জন্য। মা আটকালে সে বলেছিল “কাপুরুষের মত বসে আমি থাকব না। আমার বাবার চাইতেও বেশি সাহস প্রদর্শন করে দেশের জন্য কাজ করব।বাবা তো এটাই চাইতেন মা।” মা হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

স্বেচ্ছাসেবক ডাকা হয়েছিল।আশা করা হয়েছিল ৭০০-৮০০ জন জুটবে।কিন্তু সবাইকে অবাক করে ২০০০ এর মত প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক জড়ো হয়েছিল।দেশকে রক্ষা করবে বলে।নারী পুরুষ বৃদ্ধ সবাই।কর্মকর্তারা অবাক হলেও তাদের কাজটুকু করেছেন। পি পি ই পড়ে উদ্ধার কাজ শুরু করা হল।পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।যদি রি এক্টর ঠান্ডা করা না যায় তাহলে ব্লাস্ট হবে।এরপর তাদের কিচ্ছু করার নাই।

লোকজন গেল তাদের দ্বায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করল।ঠান্ডা করল রি এক্টর।রোবোট পাঠানো হল। গলিত মৌলের উপস্থিতি দেখা গেল। সাথে সাথে আশাপাশের ১০০ কি.মি খালি করার নির্দেশ দেয়া হল।১ লাখ মানুষ সরে গেল।জায়গাটা টোকিও থেকে মাত্র ২৫০ কি.মি দূরে।কিছু হলে খুব ভয়াবহ হবে। কাজ করতে গিয়ে আহত ও নিহত হলেন ১০০০ জনের মত স্বেচ্ছাসেবী।জাপান হারালো তাদের অনেক ইঞ্জিনিয়ারকে।বাকি স্বেচ্ছাসেবীদের দেয়া হল জাপানের হিরো উপাধী। যদিও বা অনেকেই এই উপাধী গ্রহন করেনি।সেই ছেলেটির মা এক চিঠিতে জানিয়েছিল ” আমার স্বামী ও ছেলে কোন জাতীয় নায়ক নয়।বরং তারা যা করেছে তা তাদের কর্তব্য ছিল।আমি সবাইকে আশা করব দেশের দুর্যোগের সময় এগিয়ে আসার জন্য।”

ঘটনার পর বিদুৎ কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুরু হয় এবং পারমাণবিক দূর্ঘটনার সৃষ্টি হয় এবং দুর্ঘটনার ফলে চুল্লীগুলি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে স্থায়ীভাবে সেগুলি থেকে পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব ছিল না। রাজনৈতিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে চুল্লীগুলি পুনরায় চালু করা হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *