মিথ্যা নির্দেশক যন্ত্র (Lie Detector) কি সত্যিই মিথ্যাকে চিহ্নিত করে সত্যকে খুজে বের করতে কাজ করে নাকি সব ধোকা!

আমরা মানুষেরা একটু বেশিই বুদ্ধিমান, আর এই বুদ্ধিমত্তারই আরেকটি ফিচার হলো মিথ্যা বলা বা সত্যকে লুকানো। মানুষেরা অনেক কারণে মিথ্যা বলে থাকে; নিজের জান বাঁচাতে, শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে, জেল থেকে রক্ষা পেতে ইত্যাদি। কিন্তু ন্যায় বিচার কায়েম করার জন্য মিথ্যাকে চিহ্নিত করে সত্যকে খুঁড়ে বেড় করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু ঠিক কিভাবে সঠিকভাবে সত্য/মিথ্যা যাচাই করা সম্ভব? প্রশিক্ষিত আইন অফিসারেরা বিভিন্ন প্রশ্ন করে কোন মিথ্যাবাদীকে বিভ্রান্ত করে দেয় এবং বুঝতে পারে সে মিথ্যা বলছে কিনা। তবে উপযুক্ত প্রমান এবং সাক্ষী ছাড়া কারো মিথ্যা পরিপূর্ণভাবে প্রমানিত করা সম্ভব নয়। ক্রিমিন্যাল বিভাগের বিজ্ঞানীরা অনেক বছর যাবত এমন কিছু আবিষ্কার করার চেস্টায় ছিলেন, যা সত্য, মিথ্যাকে যাচায় করার ক্ষমতা রাখে।

আমাদের সকলেই Polygraph Machine বা লাই ডিটেক্টর সম্পর্কে কোন মুভি বা টিভি সিরিজে দেখেছি অথবা বই থেকে পড়েছি। এটা কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে কৌতুহল আমাদের কমবেশি সবারই রয়েছে।

যন্ত্রটিকে যদি শরীরের সাথে সংযোগ স্থাপন করানো হয় তাহলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি মিথ্যা আমাদের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটায়, এছাড়াও মিথ্যা বলার সময় আমাদের রক্তচাপ এবং নাড়ির স্পন্দনে পরিবর্তন দেখা যায়। যন্ত্রটি সেটাই আবিষ্কার করে থাকে।

যখন আমরা কোনো ব্যাপারে সত্য বলি তখনকার প্রতিক্রিয়া এবং যখন মিথ্যে বলি তার প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়। এর ওপর আমাদের কোনো হাত নেই, আমরা না চাইতেও এই প্রতিক্রিয়া আমাদের দেহ দিয়ে থাকে। যখন আমরা মিথ্যে বলি তখন আমাদের হার্টবিট বেড়ে যায়, রক্ত চলাচল দ্রুত হয় এবং শরীর থেকে ঘাম নিঃসৃত হতে শুরু করে। যদিও তা খুব বেশি যে তা নয়, খুব ক্ষুদ্র পরিসরে তা বের হয় যা খালি চোখে দেখা যায় না। তো এই পরীক্ষায় Blood Pressure, Pulse, Body Response, Sweating এবং Skin Conductivity একসাথে পরীক্ষা করা হয়।

যেহেতু রক্ত চলাচল বেড়ে যায় তার জন্য ব্লাড প্রেসার, উত্তর দেওয়ার সময়,বাহ্যিক কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা বা চেহারা কিছুটা কোঁচকাচ্ছে কিনা তার জন্য বডি রেসপন্স ও স্কিন কন্ডাক্টিভিটি টেস্ট করা হয়। দুটো আঙুলের মধ্যে কারেন্ট পাস করার একটি মাধ্যম রাখে। আমরা সকলেই জানি লবণ পানির মাধ্যমে ইলেকট্রন পাস হতে পারে। আমরা ঘামলে ও লবণ পানি বের হয়। ফলে মিথ্যা বলার সময় কারেন্ট আগের তুলনায় বেশি পরিবাহিত হ‌য়।

যখন পরীক্ষা শুরু হয় তখন কিছু সাধারণ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করে। এতে যার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তার শরীরের সাধারণ রেসপন্স কি তা বের করা হয়। তারপর আস্তে আস্তে প্রশ্ন গভীরের দিকে যেতে থাকে।আর পরীক্ষক দেখতে থাকেন তার উত্তরের রেসপন্স প্রথম তার জন্য যে সাধারণ মানদন্ড পেয়েছে তার সমান আছে কিনা। যদি আগের তুলনায় বেশি থাকে তবে সে মিথ্যা বলছে।

যন্ত্রটি সরাসরি কোনো ব্যক্তির মিথ্যা ধরতে পারে না। বরং এটি মিথ্যা কথা বলার সময় যে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে তার দৈহিক যে সব পরিবর্তন হয় তা গ্রাফের সাহায্যে প্রকাশ করে। এই গ্রাফ বিশ্লেষণ করে বলা যায় সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে।এটি একটি অতি সাম্প্রতিক কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এটিতে অনেকটা ইসিজির ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত মিথ্যা বলার সময় আমাদের হার্টবিট বেড়ে যায়। রক্তচাপও বেড়ে যায়। শ্বাস প্রশাসের ছন্দের ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায় এবং শরীরে ঘাম নিঃসরণ বেড়ে যায়।

উল্লেখ্য, যারা পলিগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে কারো মিথ্যা বা সত্যি পর্যবেক্ষণ করে; তাদের বলা হয় পরীক্ষক এবং যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয় তাদের বলা হয় সাবজেক্ট। সাবজেক্ট বা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের আগে তার বাহু, বুক ও হাতের আঙ্গুলে তিনটি চিপ স্থাপন করা হয়। এই সব চিপ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে কম্পিউটার মনিটর হার্টবিট, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশাস এবং ইলেকট্রিক রেজিস্ট্যান্সের রিডিং গ্রাফ আকারে দেখায়।

আসামি মানসিক চাপের ফলে শারীরিক কোনো পরিবর্তন হলে গ্রাফের রিডিং পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে সাথে সাথে বোঝা যায় আসামি সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে। আসামি যদি মিথ্যা বলে তাহলে তার নিম্নোক্ত শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে-

১. রেসপিরেটরি রেট বৃদ্ধি অর্থাৎ ফুসফুসে শ্বাস প্রশ্বাসে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। কারণ সত্য যত সহজে বলা যায় মিথ্যা তৈরি করতে তার মস্তিষ্ক ব্যবহার হয়। ফলে মস্তিষ্কে অঙ্জিনের ব্যবহার বাড়ে।

২. রক্তচাপ ও হার্টবিট বেড়ে যায়। কারণ আসামিকে অধিক মাত্রায় চিন্তা করে মিথ্যা বলতে হয়। ফলে, টেনশন বাড়ে যা রক্তচাপকেও বাড়িয়ে দেয়।

৩. জিএসআর পরীক্ষার জন্য আসামির দুটি আঙ্গুলে চিপ স্থাপন করা হয়। আসামি যদি মিথ্যা বলে তাহলে তার লোমকুপগুলো সজাগ হয়ে যায়। লোমকুপ থেকে ঘাম বের হয়। ফলে ত্বকে পরিবর্তন আসে। ইলেকট্রনিক চিপ ত্বকের এই পরিবর্তন গ্রহণ করে কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেয়। মূলত এই তিন মাধ্যমের সমন্বয়ে আসামির বক্তব্যের মিথ্যা সনাক্ত করা যায়।

১৯০২ সালে এটি প্রথম James McKenzie আবিষ্কার করেন, যা ভালো মতো কাজ করতো না এবং ভুল উত্তর দিত। ফলে তা গ্রহণযোগ্য হয় নি। তারপর ১৯২১ সালে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট John Larson ক্যালিফোর্নিয়াতে এটি সংস্কার করে উন্নত রূপ দেন। পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে Leonarde Keeler এটিকে পুনরায় আরো উন্নত ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেন। এখন পর্যন্ত এভাবেই দিনে দিনে এটা আরো উন্নত হচ্ছে।

তবে মজার ব্যাপার এই যে, এই মেশিন মাঝেমধ্যে ভুল তথ্যও দিয়ে থাকে। তাছাড়া খুব Self-Control কেউ হলে তার মিথ্যা নাও ধরা যেতে পারে।অনেকে দাবি করে, তারা পলিগ্রাফকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নিজেদের শরীরকে প্রশিক্ষিত করতে পারে। ডিসকভারি চ্যানেলে পলিগ্রাফকে ধোঁকা দেওয়ার কৌশল দেখিয়ে এবং প্রমানিত করে একটি শোও সম্প্রচারিত করা হয়েছিলো। তাছাড়া এই অনেক ওয়েবসাইটে পলিগ্রাফকে ধোঁকা দেবার অনেক কৌশল বর্ণিত আছে, জাস্ট “How To Cheat a Polygraph Test” লিখে গুগল করুন, উত্তর নিজেই পেয়ে যাবেন।

তো এটি কতটা কাজের? এই প্রশ্নের উত্তরকে পরিষ্কার করার জন্য আপনাকে জানিয়ে রাখি পলিগ্রাফ অনেক দেশে অবৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং অনেক দেশে একে নিষিদ্ধও করে দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *