স্পোর্টস ডেস্কঃ শেষ ৪ বলে প্রয়োজন ১৫ রান। বোল্টের বলে ছক্কা হাঁকালেন বোল্ট। ৩ বলে প্রয়োজন ৯ রান। পরের বলে ২ রানের পাশাপাশি থ্রো থেকে বোনাস হিসেবে আসে আরো ৪ রান। শেষ বলে প্রয়োজন ২ রান ৷ ২ রান নিতে গিয়ে রান আউট হন স্টোকস, ম্যাচ গড়ায় সুপার ওভারে৷সুপার ওভারের নাটকীয়তা ১৬ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দেয় নিউজিল্যান্ডকে কিন্তু অবাক করার মতো নিউজিল্যান্ড ও করে ১৫ রান ইংল্যান্ডের সমান সমান৷ কিন্তু বেশী বাউন্ডারি মারায় ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়। সে ম্যাচে হয়তো স্টোকসের কারণে ম্যাচ জয় না শুধু ব্রিটিশদের শিরোপা এনে দিয়েছিলো বেন স্টোকস৷
স্টোকসের ক্যারিয়ারটা শেষ হয়ে যেতে পারতো ২০১৭ সালে।ব্রিস্টলের এক পানশালার বাইরে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন অ্যালেক্স হেলস। হাঙ্গামার মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। সতীর্থরা যখন অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়া সফরে, স্টোকস তখন নিউজিল্যান্ড গেছেন ক্যান্টারবেরির হয়ে খেলতে, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে। সহ-অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন এর আগেই। দলেই জায়গা নেই, আর সহ-অধিনায়কত্ব! স্টোকস ইংল্যান্ডের সে দলের ক্ষ্যাপাটে একজন।
৪ জুন ১৯৯১ সালে নিউজিল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন বেন স্টোকস৷ স্টোকস শুরুতে রাগবী খেলতো৷ মাত্র ১২ বছর বয়সে যান ইংল্যান্ডে। সেখানেই বয়স ভিত্তিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা এবং ডমেস্টিক খেলেন তিনি।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে আগস্ট ২০১১ সালে স্টোকস ইংল্যান্ড এর অভিষেক ম্যাচ খেলেন। সে বছর সেপ্টেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয় এই অলরাউন্ডারের৷ ২০১৩-১৪ এশেজে খেলেন স্টোকস। ২য় টেস্টে অভিষেক হয়ে ব্যাট হাতে ২৯ রান এবং দুই উইকেট পান তিনি। ৩য় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৮ রান এবং বল হাতে ১ উইকেট নেনে, কিন্তু ২য় ইনিংসে করেন নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন এবং দুই উইকেট ও তুলে নেন। পঞ্চম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের প্রথম ছয় উইকেট শিকারের ভেলকি দেখান তিনি। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইনজুরির কারণে মিস করেন। ২০১৫ এশেজে ১৮৭ রান করেন ব্যাট হাতে এবং বল হাতে নেন ৯ উইকেট। এরপর পাকিস্তান সিরিজে টেস্টে ৭৪ রান এবং বল হাতে পাঁচ উইকেট তুলে নেন।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি হতাশা এবং প্রাপ্তিঃ স্টোকসের জীবনে ২০১৬ একদিক দিয়ে যেমন প্রাপ্তি তেমনি অপর দিক দিয়ে হতাশা হাতাশা আর হতাশা। টি -টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪২ রান খরচে বিনা উইকেট তুলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ও বিনা উইকেটে থাকেন যদি ও ব্যাট হাতে ১৫ রান তুলে নেন এই অলরাউন্ডার। নিজের প্রথম উইকেটের দেখা পান আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে সেমি ফাইনালে স্টোকস বল হাতে দুর্দান্ত ছিলো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে৷ কিউইয়ের বিপক্ষে ২৬ রান খরচে দলের হয়ে তুলে নেন ৩ উইকেট। কলকাতার ইডেন গার্ডেনের ফাইনালে সন্ধ্যায় মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ড৷ ব্যাট হাতে ইংলিশরা শুরু করে বোল্ড আউটের যাত্রা দিয়ে৷ ম্যাচের অন্তিম লগ্ন। বল হাতে বেন স্টোকস জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রয়োজন ৬ বলে ১৯ রান। ব্যাট হাতে প্রস্তুত ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্লোস ব্রাথওয়েট। বোন স্টোকসের প্রথম বলে ছক্কা হাঁকান ব্রাথওয়েট৷
এরপরের তিন বলে টানা তিন ছক্কা মারেন ব্রাথওয়েট৷ ৪ বলে ৪ ছয় বিশ্বাস করা যায়? ধারাভাষ্যকার এর কন্ঠে ভেসে উঠে ‘ কার্লোস ব্রেথওয়েট রিমেম্বার দ্যা নেইম, হিস্টোরি ফর দ্যা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘। অবিশ্বাস্য এক মহাকাব্য ছিলো! ইডেন গার্ডেনে উপস্থিত দর্শকরা ও কি চিন্তা করতে পেরেছিলো এমনটার? কিংবা ব্যাটিং এ থাকা কার্লোস ব্রাথওয়েট কি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলো? কিংবা শেষওভারে এসে ও আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলেন ম্যাচ জয়ের? কিন্তু জয় ছাপিয়ে স্টোকসের ওমন সাদা চেহারা যেন লাল হয়ে গেলো। স্টোকস যেনো একবার কপালে হাত আরেকবার মাটিতেই বসে যাচ্ছে এমন অবস্থা৷ জয়ের উল্লাসে ভাসছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজদের দলে আর ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছিলো ইংলিশদের মনে৷ কলকাতার সে রাত বেন স্টোকস সহ গোটা ইংলিশ জাতীকে কাঁদিয়েছে, ভাসিয়েছে বেদনায়।ইংলিশ অধিনায়ক মরগানের ধারণা তার জায়গায় অন্য কেউ হলে থেমে যেতে পারত ক্যারিয়ার, স্টোকস বিশেষ কেউ বলেই ফিরে এসেছেন এবং বিশ্বজয় করেছেন, ‘বেনের কথা অনেকবারই আমি বলছি। সেদিন কলকাতায় যা হয়েছিল ওখানে অন্য কেউ থাকলে ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যেত। আমরা জানিয় অনেকবারই সে আমাদের একা টেনেছে। ও অবিশ্বাস্য এক ক্রিকেটার। এমন খেলার জন্য আমি ধন্যবাদ দিতে চাই তাকে।’
২০১৬ সালে স্টোকস বানাদেশে খেলতে আসে৷ প্রথম ওয়ানডেতেই তুলে নেন সেঞ্চুরি৷ তৃতীয় ওয়ানডেতে ২৪ খরচে নেন ১ উইকেট এবং ব্যাট হাতে ম্যাচ জয়ী ৪৭ রানের ইনিংস খেলেন৷ ১ম টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ব্যাট হাতে টোটাল ১০০+ রান এবং বল হাতে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি৷ ২য় টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে স্টোকস করেন ২৫ রান এবং বল হাতে নেন সর্বমোট ৫ উইকেট। এরপর ভারতের বিপক্ষে ১ম টেস্টের প্রথম ইনিংসে স্টোকস করেন ১২৮ এবং ২য় ইনিংসে করেন ২৮ রান।বল হাতে নেন ১ উইকেট। ২য় টেস্টে ব্যাট হাতে ৭০ রান এবং বল হাতে ১ টি উইকেট নেন বেন। সিরিজের তিন নাম্বার টেস্টে তুলে নেন ৫ উইকেট। বেন স্টোকস নিজের ২য় ওয়ানডে শতকের দেখা পান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে৷ সেবার ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আইসিসি, ক্রিকইনফো, ক্রিকবাজের বর্ষসেরা একাদশে জায়গা পেয়েছিলো বেন স্টোকস৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হ্যাডলিতে শতক এবং লর্ডসের মাটিতে ২২ রান দিয়ে ৬ উইকেট তুলে নিয়েছিলো বেন স্টোকস।
২০১৯ ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ী মহানায়ক বেন স্টোকসঃ ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। ইংলিশরা চাইবে ট্রফিখানা থেকে যান তাদের দেশেই৷ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বেন স্টোকস নিজের জাত চিনিয়ে দেন। ৮৯ রান করেন ৭৯ বলে৷ বল হাতে নেন দুই উইকেট এবং পাশাপাশি ফিল্ডিং এ দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেন। একেবারে যেন কমপ্লিট প্যাকেজ, যাকে ক্রিকেটের ভাষায় বলে অল রাউন্ডার৷ ফলাফল হিসেবে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ ও নির্বাচিত হন বেন স্টোকস৷ এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করেন অপরাজিত ৮২ রানের ইনিংস৷ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৮৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে বেন স্টোকস করেন ৮৯ রানের একটি মূল্যবান ইনিংস৷ এরপরে ভারতের বিপক্ষে নিশ্চিত জয়ের ম্যাচে ৫৪ বলে ৭৯ রানের একটি টর্নেডো ইনিংস খেলেন বেন স্টোকস। সব বাঁধা অতিক্রম করে লর্ডসের ফাইনালে ইংলিশদের প্রতিপক্ষ কিউইরা৷ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বেন স্টোকস করেন লড়াকু অপরাজিত ৮৪ রানের একটি ইনিংস, শেষ ওভারে দুই ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ নিয়ে যান সুপার ওভারে৷ এদিকে সুপার ওভারে চলে বেন স্টোকসদের তান্ডব যদি ও বাউন্ডারি সংখ্যা বেশী থাকায় ইংল্যান্ডকে জয়ী করা হয়৷ এমন অতিমানবীয় পারফরম্যান্স এর কারনে বেন স্টোকস সেই টুর্নামেন্টে ২য় বারের মতো ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরষ্কার পান। ২০১৯ বিশ্বকাপে আইসিসির টিম অফ দ্যা টুর্নামেন্টে ও জায়গা করে নেন বেন স্টোকস। বেন স্টোকসের আনন্দ যেন ফ্রেমে বন্দি করে ও রাখা যাবে না।
আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বেন স্টোকস বলেন “এই পুরস্কার আমার সতীর্থ ও সাপোর্ট স্টাফের জন্য স্বীকৃতি। তাদের সমর্থন ছাড়া আসলে আমরা এরকম একটা ট্রফি জিততেই পারতাম না।”
বেন স্টোকসের জন্য কলকাতার সেই কালো রাত, ব্রিস্টলের সেই রাতে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পরা থেকে তিনি নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন লর্ডসের সেই ফাইনালে৷ সর্বশেষ অ্যাশেজের হেডিংলি টেস্টের কথা মনে আছে? যে ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে ইংল্যান্ডকে অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিয়েছিলেন বেন স্টোকস। ইংলিশদের কাছে খলনায়ক বনে যাওয়া স্টোকসই এখন তাদের মহানায়ক।
Leave a Reply