ইউনিভার্সিটির লিওনার্ড হলের ২১৪ নাম্বার রুম, সকাল ঠিক ১১:১৫। সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে আছি। ক্লাস নিবেন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রফেসর ড. ইরাজ হোসেন পাওলি, ভদ্রলোক জাতিতে তার্কিশ। আমেরিকাতে প্রফেসরগিরি শুরু করেছেন মোটামুটি বিশ বছর আগে। কোর্সের নাম থিওরি অফ প্লাস্টিসিটি।বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং মেটেরিয়াল এর ফেইলিউর ক্রাইটেরিয়া নিয়ে মোটামুটি দাঁত ভাঙ্গা টাইপের গ্রেজুয়েট লেভেলের কোর্স।সাধারণত আমাদের মতো অপারগ ইন্টারন্যাশনাল পিএইচডি স্টুডেন্টরাই এসব কোর্স নেয়, যাদের ভরণ-পোষণ করে ইউনিভার্সিটি। আন্ডারগ্রেড এর সিনিয়র ইয়ারের ছেলেমেয়েদের প্রফেসর সাহেব অনেক বুঝিয়েও এই কোর্সে এনরোল করাতে পারেনি। তাদের কথা, খামোখা টাকা দিয়ে এতো কঠিন কথাবার্তা শুনার দরকার কী? তো যাই হোক, “বসেঞ্জার ইফেক্ট” নামক একটা টপিক নিয়ে কথা বলতে বলতে প্রফেসর চলে গেলেন মেটেরিয়াল এর একটা বিশেষ প্রোপার্টি নিয়ে আলোচনায়, যার নাম, “ডাক্টাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন”। আর ক্লাস শেষে ধরিয়ে দিলেন ১৯৯৩ সালে জাপানের নাগোইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের করা পিএইচডি থিসিস। বললেন থ্যাংকস গিভিং এর লম্বা বন্ধে এটা পড়ে ফেলতে। আর বন্ধের পরে ক্লাস খুললে কেস স্টাডি হিসেবে, এই থিসিস থেকে নেয়া ধারণার আলোকে টাইটানিক জাহাজের দুর্ঘটনা ব্যাখা করতে। যদিও এই ১৫০ পাতার থিসিসে কোথাও টাইটানিক জাহাজের নামও নাই। কিন্তু কিছুই করার নাই, এটাই গ্রেজুয়েট স্টাডি। আমার অন্য ক্লাসমেট (আরেক পিএইচডি স্টুডেন্ট) প্রফেসরকে জানাইয়া দিছে, তার স্ত্রীর ডেলিভারি টাইম কয়েকদিনের ভিতর, সো, সে এখন এসব জাহাজ ডুবাডুবির মধ্যে নাই। এখন এই ১৫০ পাতার থিসিস নিয়ে আমি পড়ে গেলাম অথৈ সাগরে।
আমি আদার বেপারি, কোনদিন জাহাজের খবর নেই নাই, টাইটানিকতো দূরের কথা। তবে, টাইটানিকের কথা মাথায় আসলে, যে স্মৃতি বা কথা মনে আসে তা হলো, এইটা হইলো আল্লাহর মাইর, অহংকার করলে এমনই হয়। আর যারা একটু মোটামুটি জানে বুঝে তাদের কাছে শুনেছি বড় এক বরফের ধাক্কায় জাহাজের তলা ফেটে ডুবে গেছে। তবে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন একবার সামাজিক বিঞ্জান ক্লাসে এটা নিয়ে কথা আসলে, আমি সম্ভবত ক্লাসের ম্যাডামকে জিঞ্জাসা করেছিলাম যে, কেনো একটা লোহার জাহাজ পানির তৈরী বরফের আঘাতে ফেটে গেল? যতোদূর মনে পড়ে সামাজিক বিঞ্জান ম্যডামের উত্তর ছিল, “তুমি ব্যাপারটা নিয়ে বেশী বুঝে ফেলছো, আমি ওতো জানি নাহ।“ সমাজিক বিঞ্জানের ম্যাডাম, এতো দিল্লী হিল্লী না জানাই স্বাভাবিক। যাই হোক এর পর আমিও এসব জাহাজ ভাঙ্গাভাঙ্গির কারণ খোজা বাদ দিয়ে, ক্লাসের বাকি সবার মতো টাইটানিকের নায়িকার সোন্দর্যের কারণ জানা, আর সিনেমার সেই ছবি আকার চুলকানি দৃশ্য নিয়ে কথা বার্তা বলায় বিজি থেকে গেলাম। কিন্তু, এবার আর উপায় নাই, টাইটানিক আমার ঘাড়ের উপর। থ্যাংকস গিভিং বন্ধের প্রথম দুইদিনেই থিসিস পড়ে শেষ করে ফেললাম। মোটামুটি যা বুঝলাম, এখানে থিসিস লেখক মূলত, স্টিলের উপর তাপের প্রভাব নিয়ে জটিল গাণিতিক হিসাব নিকাশ করে, গ্রাফ তাফ একে তার কাজ প্রদর্শন করেছেন। থিসিস পড়ার পর বাকি কাজটুকুর জন্য নিলাম ইন্টারনেটে থাকা বিভিন্ন রিসোর্স। সব কিছু মিলেয়ে দাড়া করালাম মোটামুটি গ্রেজুয়েট স্টুডেন্ট লেভেলে প্রেজেন্ট করা যায় এমন একটা রিপোর্ট।
এখন আমি এই টাইটানিকের এরকম দুর্ঘটনার আসল কারণটা কোন অংক মংক ছাড়াই যতোটা পারি বুঝিয়ে বলবো। কারণ এটা আমার জীবনেও এতোগুলো দিন পার করে এসে তারপর বুঝা লাগছে। আসলে এই ঘটনার খলনায়ক হিসেবে অলমোস্ট সবাই দোষী করে সে বড় বরফের টুকরাটিকে। কিন্তু আসলে সেই বরফ বেচারার কী দোষ, সেতো আর যেচে এসে টাইটানিককে আঘাত করেনি। বরং টাইটানিক ই এসে সেটাকে আঘাত করেছে। আচ্ছা, যদি আঘাত করেই থাকে, তারপরও, কেন একটা লোহার/স্টীলের বানানো জাহাজ সামান্য নরম বরফের আঘাতে ভাংবে। তাও আবার এটা কোন ভাঙ্গারি মুড়ির টীনের জাহাজ নাহ, ব্রান্ড নিউ চকচকে জাহাজ, প্রথম যাত্রায় বেরিয়ে ছিলো। ব্যাপারটা এমন না যে, আপনি ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে হাতুড়ি দিয়ে বারি দিলেন, আর আপনার হাতুড়ির লোহাটা গেল ভেঙ্গে? এটা কী কখনো হয়? না এটা হবার কথা নাহ। তাহলে আসল কারণ কী? যেটা আসল কারণ, সেটা হলো টেম্পারেচার বা তাপমাত্রা।ধাতু/মেটালের উপর তাপমাত্রার প্রভাব ব্যাপক। সোজা ভাবে বললে, তুলনামূলক বেশী তাপমাত্রায় ধাতু/মেটাল নরম/সফট থাকে, যেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ বলা হয় “ডাকটাইল মেটারিয়াল’ আর তাপমাত্রা কমে গেলে ধাতু/মেটাল শক্ত হয়ে যায়, বা কাচের মতো ভঙ্গুর হয়ে যায়, আর সেটাকে বলে “ব্রিটল মেটারিয়াল”। ব্রিটল বিস্কুট এর যে এড টিভিতে দেখাতো তার নাম আসলে এইখান থেকেই ধার নেয়া।
ইঞ্জিনিয়ারিং এ সব সময় “ডাকটাইল মেটাল” প্রেফার করা হয়। কারণ বাংলা মুভির মতো সহজে বললে, “ডাকটাইল মেটাল” হলো মচকে যাবে তবু ভাংবে নাহ, আর “ব্রিটল মেটাল” হলো ভেঙ্গে যাবে তবু মচকাবে নাহ। আরো সহজে বললে, একটা জীবিত মোটা সোটা কাচা গাছের ডালে আপনি বসলে সেটা সামান্য বাকাবে, কিন্তু ভাংবে নাহ, আবার আপনি যদি সেম সাইজের একটা শুকনা গাছের ডালে বসেন সেটা কট করে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এখানে কাচা গাছের ডালটা ডাকটাইল মেটেরিয়ালের মতো আচরণ করলো আর শুকনা ডালটা করলো ব্রিটল মেটেরিয়ালের আচরণ। আশা করি এখন ক্লিয়ার। তো তাপমাত্রায় ফিরে আসি। তারমানে ইঞ্জিনিয়ারিং যেকোন স্ট্রাকচারের মেটেরিয়ালের জন্য একটু বেশি তাপমাত্রা কাঙ্ক্ষিত যাতে স্ট্রাকচারটা ডাকটাইল থাকে, ব্রিটল হয়ে যাতে ভেঙ্গে না যায়। আর এই তাপমাত্রা বা টেম্পারেচার চেঞ্জ হয়ে যাবার কারণে মেটাল বা ধাতু ডাকটাইল (নরম) থেকে ব্রিটল (শক্ত/ভঙ্গুর) হয়ে যাবার প্রক্রিয়াকে বলা হয় “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন”। মূলত যে থিসিসটা আমাকে পড়তে দেয়া হয়েছিল তা ছিল স্টিলের “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন” প্রক্রিয়ার উপর।
টাইটানিকের ক্ষেত্রে এখানেই মেটেরিয়াল ডিজাইনিং এ ভুলটা হয়ে গিয়েছিল। টাইটানিক জাহাজের “হল/স্ট্রাকচার” (ছবিতে কালো অংশ) বানানো হয়ে ছিল “মাইল্ড স্টিল” দিয়ে। এমনিতে অসটেনাইট স্টিলের ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন হবার জন্য যে তাপমাত্রা লাগে সেটা বেশ কম (হিমাঙ্গেকের নিচে বা আশেপাশে) সাধারণত এতো কম টেম্পারেচারে অসটেনাইট স্টিলের বানানো কোন স্ট্রাকচার অপারেট করা হয়না। কিন্তু টাইটানিক জাহাজ এই অস্টেনাইট স্টিলে বানানো ছিলো নাহ, এটার “হল/স্ট্রাকচার” বানানো হয়েছিল “মাইল্ড স্টিল” দিয়ে। কারণ সেই সময়টাতে (১৯০৯-১৯১২ সালে) এতো উন্নত প্রযুক্তির স্টিল বানানো সম্ভব ছিলো নাহ যেটা এখন সম্ভব কিংবা হয়তোবা থাকলেও তা ব্যবহার করা হয়নি।জাহাজের স্ট্রাকচারের চেয়ে নান্দনিক সোন্দর্যের দিকে বেশী নজর দেয়া হয়েছে। এনিওয়ে, এখন যে মাইল্ড স্টিল দিয়ে টাইটানিক জাহাজের “হল/স্ট্রাকচার” বানানো হয়েছিল তার “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন” টেম্পারেচার ছিল ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানে টাইটানিকের এই মাইল্ড স্টিলের “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন টেম্পারেচার” এতো বেশী হবার কারণ, পরবর্তিতে গবেষণায় দেখা গেছে যে, সেই মাইল্ড স্টিলে কার্বণ ছাড়াও সালফার এবং ফসফরাসের ইমপিউরিটি ছিল। কিন্তু ওয়েদার আর আটলান্টিকের পানির তাপমাত্রা খেয়াল করলে দেখা যায়, সেদিন টাইটানিক চলছিল প্রায় -২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের হিমশীতল জলের উপর দিয়ে। এখন টাইটানিক জাহাজের স্টিলের “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন” টেম্পারেচার হলো ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর সেটা চালানো হচ্ছিল দেদারছে -২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আটলান্টিকের শীতল জলের উপর দিয়ে।
যার কারণে যা হবার তাই হলো, জাহাজের কাঠামো আর “ডাকটাইল/নরম স্টিল” থাকলো নাহ, তা হয়ে গেল, ব্রিটল/ভঙ্গুর/শক্ত কাচের মতো কাঠামো। যেটা উপরে বলা সেই শুকনা গাছের ডালের মতোই আচরণ করলো। যখন বরফের সাথে জাহাজের স্টারবোর্ড/ডানপাশটা ধাক্কা দিলো, তখন শুকনো গাছের ডালের মতোই ভেঙ্গে গেল, আর জাহাজের মোট ১৬ টা ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্টের ৫/৬ টাই প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। জাহাজের মূল ডিজাইন অনুযায়ী, ১৬ টার ভিতর ৪ টা পর্যন্ত ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট প্লাবিত হলে জাহাজ না ডুবে ভেসে থাকতে পারতো কিন্তু যেহেতু ৫/৬ টা ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, সেহেতু সলিল সমাধি ছাড়া টাইটানিকের কপালে আর ভালো কিছুই হবার ছিলো নাহ। অথচ টেমপারেচার যদি সেদিন এতোটা কম না থাকতো, তাহলে হয়তো সেদিন জাহাজে বড় ফাটল না হয়ে সামান্য ডেন্ট হতো, যেরকমটা গাড়ি গাড়িতে মাইনর কলিশন হলে হয়। তাহলে এই হলো আসল ঘটনা। আমি আশা করি আমার মতো অনেকের জীবনেই আজ একটা মিস্টেরির জট খুললো। আর বেচারা বরফের গাঢ় থেকে দোষের বোঝা কিছুটা হলেও নেমে গেল। আসলে এই “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন টেম্পারেচারই” হলো এই ঘটনার মূল কারণ।
আপনি চাইলে নিজে নিজেও বাসায় বসে এরকম একটা টেস্ট করে ফেলতে পারেন।দোকান থেকে একটা চুইংগাম কিনে পকেটে নিয়ে ঘুরেন। দেখবেন শরীরের গরমে সেটা বেশ ডাকটাইল বা নরম থাকবে। সহজে ভাংবে নাহ, কিন্তু সেই চুইংগামটাই ডিপফ্রিজে ১ ঘন্টা রেখে যাস্ট বের করে একটু হাত দিয়ে বাকান, দেখবেন কট করে ভেঙ্গে যাবে। টাইটানিকের নিম্নমানের সেই মাইল্ড স্টিল কাঠামোও, আটলান্টিকের হিমশীতল জলে সেদিন এই ডিপফ্রিজে রাখা চুইংগামটার মতোই আচরণ করেছিল। যদিও চুইংগাম পলিমার আর টাইটানিক মেটাল বা ধাতু।(সাধামাটা ভাবে বললে, পলিমারে সেম জিনিসটাকেই “ডাকটাইল টু ব্রিটল ট্রানজিশন টেম্পারেচার “না বলে বলা হয়ে থাকে “ গ্লাস ট্রানজিশন টেম্পারেচার” ।এই জিনিস বিমানের স্ট্রাকচারে জরুরী, কারণ আধুনিক বিমানগুলোর স্ট্রাকচার ফাইবার দিয়ে রিইনফোরসড করা পলিমার দিয়ে তৈরি। এটা নিয়ে আজ জটিল আলোচনায় না যাই, অন্য কোন দিন বলা যাবে।)
খনকার দিনে আমরা মোটামুটি যেকোন একটা ভালো মানের ল্যাপটপ থাকলেই, বাজারে এভেইল এভেল থাকা যেকোন ফাইনাইট এলিমেন্ট এনালাইসিস সফটওয়্যার দিয়ে এসব ফ্রাকচার টাফনেস/ হিট ট্রান্সফারের সমস্যা এনালাইসিস করে ফেলতে পারি। আমার নিজের ল্যাপটপেই দেখলাম ৩ টা ইন্সটল করা আছে, কিন্তু সে সময় কম্পিউটেশনাল/সিমুলেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর এতো ব্যাপক সুবিধা ছিল নাহ। যা করার তা এক্সপেরিমেন্ট বা প্রোটোটাইপ বানিয়েই করতে হতো। সুতরাং এধরনের ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক নাহ। আর টাইটানিকের হর্তা-কর্তারাও জাহাজের কাঠামোর স্ট্রেন্থ বা শক্তির দিকে বেশী নজর না দিয়ে, এর বিউটিফিকেশন বা নান্দনিকতা নিয়েই বেশী ব্যস্ত ছিলেন বলেও বিভিন্ন লেখালেখিতে পেয়েছি। আসলে, পুঁজিবাদী দুনিয়ায় আই-ওয়াশ আর মুনাফাই ছিল সব। আশা করি এতোক্ষণে, সবার পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে এ ব্যাপারে।
বিঃদ্রঃ লেখাটা সহজভাবে লিখতে গিয়ে সেই থিসিস পেপার ছাড়াও অনেক অনলাইন রিসোর্চের হেল্প আমাকে নিতে হয়েছে, যেগুলোর একটা লিস্ট নিচে দিয়ে দিলাম। আগ্রহ থাকলে পড়ে/ঘুরে দেখতে পারেন।
আর্টিকেল লিখেছেনঃ আতিক স্যার, যুক্তরাষ্ট্র।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply