একসময় ডায়েরি লেখা খুব জনপ্রিয় ছিল। আমি নিজেও স্কুলজীবনে ডায়েরি লিখতাম। অনেকগুলো ডায়েরি আমার সংগ্রহে ছিল, তাতে বিভিন্ন রঙিন কালির কলম দিয়ে সময় উল্লেখ করে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দরকারি বিষয় বা ঘটনা লিখে রাখতাম। কখনও ফুল, প্রজাপতি, গাড়ি, এয়ারপ্লেন প্রভৃতির রঙিন স্টিকার লাগিয়ে সাজাতাম। তারপর প্রযুক্তি অর্থাৎ মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদির ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ডায়েরি লেখা ছেড়ে দিয়েছি। আমার সেই ডায়েরিগুলো আলমারির কোণায় ধুলো জমতে জমতে একদিন কাগজ ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে ঠাই নিয়েছে।
কয়েক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রোজেক্টের কাজের প্রয়োজনে দুই ঘণ্টা ব্যয় করে কাগজ কলমে মাইন্ড ম্যাপ বানানোর পর আমি নতুন করে উপলব্ধি করলাম কোন ডিজিটাল ডিভাইস বা অ্যাপ সনাতন পদ্ধতির কাগজ, কলমের চেয়ে কার্যকরী হতে পারে না। এবং তারপর আমি আবার পুরনো পদ্ধতিতেই ফিরে গেলাম আমার নিত্যদিনের কাজের পরিকল্পনা করার জন্য। অর্থাৎ ডায়েরি, কলম-পেন্সিল আবার আমার টেবিলে জায়গা করে নিল।
অনেকেই ভ্রূ কুঁচকে বলবেন, সময় কোথায়?
এবং কথাটা অনেকাংশে ঠিক। ডায়েরি লেখা বলতে যে পাতার পর পাতা গল্প কাহিনীর মত লিখে যাওয়া আমরা সাধারণত বুঝি সেটা এই সময়ে কেউ করতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। স্মৃতি তো এখন আমরা ডায়েরি কিংবা এলবামে রাখি না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ধরে রাখি। আরও বেশি সুবিধা পাই, স্মৃতি জমিয়ে রাখার পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে ভাগ করেও নিতে পারি সহজেই। ডায়েরি যেটা দিতে পারে না।
কিন্তু আমি ডায়েরিতে স্মৃতি ধরে রাখার কথা বলছি না। আমি বলছি ডায়েরি বা নোটবুক ব্যবহার করে প্রতিদিনের কাজের তালিকা করা এবং পরবর্তীতে কতটুকু কাজ শেষ করেছেন এবং কতোটা বাকি রয়ে গেল তার তুলনা করার কথা। প্রতিদিন মাত্র দশমিনিট ব্যয় করে এই কাজটি করতে পারলে কিছুদিন পর আপনি এর সুফল দেখে নিজেই অবাক হবেন। ছোট এই কাজটি, যেটা আপাতদৃষ্টিতে অযথা বলে মনে হয় সেটা মাত্র কয়েকদিনেই আপনাকে আগের চেয়ে অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী এবং দক্ষ করে তুলতে পারে। আর এই কাজটির পোশাকি নাম হচ্ছে “বুলেট জার্নালিং”।
কাগজ, কলম এবং ইচ্ছাশক্তিই মূল উপকরণআমার কথা বিশ্বাস না হতে পারে। কিন্তু গুগল বা ইন্সটাগ্রামে বুলেট জার্নাল ( কিংবা সংক্ষেপে BuJo) লিখে সার্চ দিলেই বুঝতে পারবেন এই পদ্ধতির কয়েক মিলিয়ন অনুসারী আছেন যারা বিশ্বাস করেন এটি আসলেই কাজ করে। কিভাবে বুলেট জার্নালিং অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে এমন গল্পও পাবেন। কিন্তু খুঁজতে যাবার আগে জরুরি সতর্কবাণী, ইন্সটাগ্রামে যেসব নিখুঁত সুন্দর বিভিন্ন রঙে, নকশায়, হাতে আঁকা ছবি কিংবা স্টিকার দিয়ে সাজানো বুলেট জার্নাল দেখবেন এবং এই কাজ আমাকে দিয়ে হবার নয় ভেবে পালাবার রাস্তা খুঁজবেন – তার আগে জেনে নিন এইসব সাজসজ্জা বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ আপনি যদি ভাবেন যে আপনি শিল্পীমনের অধিকারী এবং আপনার প্রতিটি কাজ হওয়া উচিত নিখুঁত শিল্প ( এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু বাহবা পেতে চান ) তাহলে আলাদা ব্যাপার, কিন্তু আপনি যদি এমন কেউ হন যে আপনার লক্ষ্য পূরণ হওয়াই মূল উদ্দেশ্য তাহলে এমন কিছুরই দরকার হবে না। সাদা কাগজ, একটি কলম আর আপনার ইচ্ছেশক্তিই বুলেট জার্নালের মূল উপকরণ।
ব্রুকলিনের অধিবাসী ডিজাইনার রাইডার ক্যারোল ২০১৩ সালে প্রথম বুলেট জার্নালের ধারণা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। তিনি অল্প বয়সে লারনিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হন। যেহেতু গুছিয়ে চিন্তা করা বা মনোযোগ সংক্রান্ত সমস্যায় তিনি ভুগতেন, সে কারণেই প্রাত্যহিক কাজ জটিলতামুক্ত উপায়ে সম্পন্ন করতে একটি সহজ উপায় খুঁজছিলেন তিনি। আর এভাবেই তিনি বুলেট জার্নাল ব্যবহার শুরু করেন। নিজে সুফল পাবার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন অন্যদেরকে তার পদ্ধতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার, তার লক্ষ্য ছিল কোন জটিলতামুক্ত সহজ পদ্ধতির সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যেটা প্রতিদিনের কাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি অতীতের কাজের সাথে বর্তমানের সমন্বয় ঘটাতে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতের কাজের অগ্রিম পরিকল্পনা করাও সহজ হবে। তার এই পদ্ধতি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় যেটা তিনি নিজেও আশা করেননি। অনলাইন দুনিয়ায় সহজলভ্য বুলেট জার্নাল অনুসারীদের করা জটিল ডিজাইনের জার্নাল সম্পর্কে তার মতামত খুবই সোজাসাপ্টা,
” অনলাইনে কি দেখেন তা ভুলে যান, এটি মোটেও কেমন দেখাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে না, আপনার অনুভূতির উপর নির্ভর করে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আপনার জন্য এটি কিভাবে কাজ করে তার উপর নির্ভর করে। ”
তাহলে বুঝতেই পারছেন, দুশ্চিন্তা করার কিছুই নেই। এখন দেখে নিন রাইডার ক্যারোলের বুলেট জার্নালের সহজ ও সাধারণ নিয়মগুলো।
বুলেট জার্নালের ভাষাকে বলা হয় র্যাপিড লগিং, যদিও এটি কোন বিশেষ ভাষা নয়। বুলেট জার্নালের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট প্রতীক ব্যবহার করে যে কোন কিছু সবচেয়ে সংক্ষিপ্তভাবে লেখার নাম র্যাপিড লগিং।
বুলেট জার্নালে সাধারণত কোন কাজ, ঘটনা ও এগুলো সম্পর্কে মন্তব্য বা টীকা লেখা হয়। কিছু প্রতীক ব্যবহার করে এদেরকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়। কোন কাজ বোঝাতে ডট, ঘটনা, মিটিং না অনুষ্ঠান সম্পর্কে ছোট বৃত্ত দিয়ে লেখা হয়। কাজ বা ঘটনার চুম্বক অংশ বা জরুরী কিছু বিষয় না মন্তব্য ড্যাশ দিয়ে লেখা হয়। যে কাজটি সমাপ্ত করছেন সেটি ক্রস দিয়ে কেটে দিন।
এই প্রতীক বা চিনহগুলো ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয় অবশ্য। নিজের পছন্দ ও সুবিধামত প্রতীক বেছে নিতে পারেন।
বুলেট জার্নাল সাজাতে,প্রথমে একটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ রাখতে হবে সূচিপত্রের জন্য, এতে করে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরবর্তীতে খুঁজে পেতে সুবিধা হবে।
এরপর একটি পৃষ্ঠা রাখতে পারেন ব্যবহৃত প্রতীকগুলো লিখে রাখার জন্য। যেমন – কাজ বা ঘটনা বোঝাতে কোন প্রতীক ব্যবহার করছেন কিংবা কোন কাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ বুঝাতে কোন রঙ দিয়ে চিহ্নিত করেছেন ইত্যাদি।
বুলেট জার্নাল সাপ্তাহিক প্ল্যানারতারিখ উল্লেখ করে প্রতিদিনের কাজের তালিকা করুন। এরপর আপনার সুবিধা অনুযায়ী সপ্তাহ, পনের দিন কিংবা একমাস শেষে কতটুকু কাজ শেষ করেছেন এবং কতটুকু বাকী রয়ে গেছে তা যাচাই করুন। সমাপ্ত কাজ ক্রস দিয়ে কেটে দিন এবং অসমাপ্ত কাজ ভবিষ্যৎ কাজের তালিকায় যোগ করুন।প্রতিদিনের কাজের তালিকার পাশাপাশি করতে পারেন ভিন্নধর্মী কিছু। যেমন – পছন্দের কিছু বইয়ের তালিকা যেগুলো পড়তে চান কিংবা দেখতে ইচ্ছুক এমন সিনেমা বা টিভি শো’র তালিকা।
নতুন অভ্যাস গড়ে তুলতেও সাহায্য করবে বুলেট জার্নাল। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করতে চান? একটা তালিকা করে প্রতিদিনের জেগে ওঠার সময় লিখে রাখুন, কিছুদিন পর যাচাই করলেই বুঝবেন সফল হচ্ছেন নাকি ” আজ ঘুমাই, কাল থেকে তাড়াতাড়ি উঠবো ” বলে দেরিতেই উঠছেন। এভাবে ডায়েট প্ল্যানার, ব্যায়াম করার জন্য ফিটনেস প্ল্যানার ইত্যাদি বানাতে পারেন।
প্রথমত, বুলেট জার্নাল আপনি নিজের হাতে লিখছেন। লেখার ফলে মস্তিষ্ক সংকেত পায় যে কাজটি জরুরী এবং সহজে আর ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে না। এছাড়া লেখা রেকর্ড থাকলে এবং দিনের শুরুতে সেদিনের কাজের তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয় যে, কোন কাজটি বেশি জরুরী আর কোনটি কম। এতে করে অদরকারি কাজে সময় নষ্ট না করে জরুরী কাজ আগে করা হয়। ব্যস্ত থাকার মানে এই না যে প্রয়োজনীয় কাজই করা হচ্ছে, অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজেও সময় চলে যায়। হাতে লিখে তুলনা করে কাজ বাছাই করলে এসব অদরকারি কাজ করার পরিমাণ কমে আসবে নিঃসন্দেহে।
প্রতিদিন কত আইডিয়া মাথায় আসে। সব মনে রাখা সম্ভব হয় না, হয়ত চমৎকার কিছু আইডিয়া ভুলে যাবার কারণে হারিয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যৎ কাজের তালিকা বানিয়ে সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখলে সেগুলো আর হারাবে না। হয়ত এই আইডিয়া থেকে চমৎকার কোন কাজ করে ফেলতে পারেন কিংবা কিছুদিন পর অন্য কাজের সাথে তুলনা করে অযথা বা অদরকারি বলে বাদ দিতে পারেন। এতে যাচাই না করে কোন আইডিয়া নিয়ে কাজ করে সময় নষ্ট হবার থেকে বেঁচে যাবেন।
সবকিছু মনে রেখে কাজ করতে গেলে মাথায় চাপ পড়ে যায় বেশি। যদি লিখে রাখেন সব দরকারি বিষয়, তাহলে মনে রাখার কষ্ট করতে হবে না। চিন্তামুক্ত মনে কাজ করলে কাজে মনোযোগ বেশি পাবেন এবং কাজটি আগের চেয়ে বেশি ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন।
মোটকথা, বুলেট জার্নাল নিজেকে মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন মাত্র দশ মিনিট বুলেট জার্নাল লেখার অভ্যাস তাই আপনাকে আগের চেয়ে পরিশ্রমী, অধ্যাবসায়ী ও দক্ষ করে তুলতে পারে কিছুদিনের মধ্যেই।
Leave a Reply