স্পোর্টস ডেস্কঃ ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলা অত্যন্ত পছন্দ করতাম। শুধু পছন্দ না অনেক খানি পছন্দ করতাম৷ খেলাধুলায় পছন্দ ক্রিকেট দিয়ে শুরু হলে ও এরপর ফুটবলই আমাকে আকৃষ্ট করেছে একবার দু’বার না বহুবার করেছে আকৃষ্ট। ২০১০ ফুটবল বিশ্বকাপের সময় বয়স সবে মাত্র আমার ৮ তখন থেকেই বিশ্বকাপে ব্রাজিল সাপোর্ট করা শুরু করা৷ এরপর আস্তে আস্তে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের প্রতি একটা টান আসে আমার মনে, দেখতে দেখতে ২০১৩ সাল আসলো। বয়স ১১ থেকেই সাপোর্ট করা শুরু করি জুভেন্টাস, বার্সেলোনা দলকে ও। এরপর বার্সেলোনা আমাকে এতটাই আনন্দ, মুগ্ধতা, বিস্ময় করেছে যে আমার পছন্দের তালিকায় এই বার্সেলোনা এখন নাম্বার ওয়ান দল হয়ে গিয়েছে৷ কত সন্ধ্যা, রাত, গভীর রাত পর্যন্ত তাদের ১১ জনের খেলা দেখেছি, দেখেছি আমি লাল নীলের ভালোবাসার সৈনিকদের। দেখেছি বার্সেলোনার শর্ট পাস ” টিকিটাকা “। মুগ্ধতার সাথে দেখেছি জাভি- ইনিয়েস্তার পাসিং, অবাক করে দেখেছি মেসির বাম পায়ের শট, বুক ভরা আনন্দ নিয়ে দেখেছি মেসি – নেইমার – সুয়ারেজের জুটি দেখেছি৷
এই কাতালান ক্লাবটি কি শুধুই আমাদের আনন্দ দিয়েছে? না আনন্দের কত রাতের পাশাপাশি কত বেদনার রাত ও উপহার দিয়েছে বার্সেলোনা৷
ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা একটি পেশাদার ফুটবল ক্লাব, যা স্পেনের কাতালুনিয়ার বার্সেলোনা শহরে অবস্থিত। হুয়ান গাম্পের নামক এক ভদ্রলোকের নেতৃত্বে ১৮৯৯ সালে একদল সুইস, ইংরেজ ও কাতালান নাগরিক দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্লাবটি কাতালান সংস্কৃতির এবং কাতালুনিয়ার জাতীয়তাবাদের একটি প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে, যার মূলমন্ত্র হল “Més que un club” (একটি ক্লাবের চেয়েও বেশি)।এছাড়া ক্লাবের একটি অফিসিয়াল থিম সঙ্গীতও রয়েছে, যার শিরোনাম কান্ত দেল বার্সা(Cant del Barça), যা জাইমা পিকাস এবং ইয়োসেপ মারিয়া এস্পিনাস কর্তৃক লিখিত। ক্লাবের নির্দিষ্ট কোন মালিকানা নেই, বরং সমর্থকরাই এর মালিকানা বহন করে এবং তারাই এর পরিচালক। ফোর্বস অনুযায়ী বার্সেলোনা বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ মূল্যবান ক্লাব, যার সম্পদের পরিমাণ ৪.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং উপার্জনের দিক থেকে এটি বিশ্বের তৃতীয় ধনী ক্লাব, যার বার্ষিক উপার্জন ৬৪৮.৩ মিলিয়ন ইউরো।
ঘরোয়া প্রতিযোগিতা গুলোর মধ্যে বার্সেলোনা ২৬টি লা লিগা, ৩০টি কোপা দেল রে, ১৩টি স্পেনীয় সুপার কাপ, ৩টি কোপা এভা দুয়ার্তে এবং ২টি কোপা দে লা লিগা ট্রফি জিতেছে। আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলে বার্সেলোনা বিশটি ট্রফি জিতেছে, যার মধ্যে রয়েছে ৫টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ, রেকর্ড ৪টি উয়েফা কাপ উইনার্স কাপ, যৌথ রেকর্ড ৫টি উয়েফা সুপার কাপ, রেকর্ড ৩টি ইন্টার সিটিজ ফেয়ার্স কাপ এবং যৌথ রেকর্ড ৩টি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ।
আইএফএফএইচএস কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব ক্লাব র্যাংকিং-এ বার্সেলোনা ১৯৯৭, ২০০৯, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৫ সালে শীর্ষস্থান অর্জন করে এবং উয়েফা ক্লাব র্যাংকিং এ বর্তমানে ৩য় স্থানে অবস্থান করছে।বার্সেলোনা বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ সমর্থিত ফুটবল দল এবং প্রধান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সমর্থক থাকা দলগুলোর মধ্যে একটি। বার্সেলোনার খেলোয়াড়গন রেকর্ড সংখ্যক বালোঁ দ’অর এবং ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন। ২০১০ সালে ক্লাবটি ইতিহাস গড়ে যখন ক্লাবের যুব একাডেমী থেকে উঠে আসা তিন জন খেলোয়াড়কে (মেসি, ইনিয়েস্তা এবং জাভি) ফিফা বালোঁ দ’অর পুরস্কারের শীর্ষ তিনে মনোনীত করা হয়।বার্সেলোনাই একমাত্র ইউরোপীয় ক্লাব, যা ১৯৫৫ সালের পর থেকে প্রতিটি মৌসুমেই মহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে এবং অ্যাথলেতিক বিলবাও ও রিয়াল মাদ্রিদের মত তাদেরও কখনও লা লিগা থেকে অবনমন ঘটেনি।
২০০৯ সালে বার্সেলোনা প্রথম স্পেনীয় ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জয় করে (লা লিগা, কোপা দেল রে এবং চ্যাম্পিয়নস লীগ)। ঐ একই বছর তারা বিশ্বের প্রথম ফুটবল ক্লাব হিসেবে এক বছরে ছয়টি শিরোপার সবকয়টি জিতে সেক্সটাপল সম্পন্ন করে। সে বছর তারা পূর্বে উল্লেখিত ট্রেবলসহ স্পেনীয় সুপার কোপা, উয়েফা সুপার কাপ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে। ২০১১ সালে বার্সেলোনা পুনরায় চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জিতে এবং সে বছর তারা মোট ৫টি শিরোপা জিতে, শুধুমাত্র কোপা দেল রে শিরোপা তাদের হাতছাড়া হয়। পেপ গার্দিওলার অধীন বার্সেলোনা দলকে, যেটি ৪ বছরে ১৪টি শিরোপা জয় করতে সক্ষম হয়, সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল দল মনে করা হয়।২০১৫ সালের ৬ জুন, চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জয়ের মাধ্যমে ইউরোপের প্রথম দল হিসেবে বার্সেলোনা দুইবার ট্রেবল জেতার রেকর্ড গড়ে।এটি খেলোয়াড়দের সবচেয়ে বেশি বেতন দেওয়া ক্লাব।প্রতি বছর খেলোয়াড়দের £১০ মিলিয়নের ($১৩.৮ মিলিয়ন) এর বেশি দেওয়া হয়।
ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার ক্ষেত্রে একটি প্রচলিত ইংরেজি কথা আছে, ” Barcelona More than a Club’। আসলেই যেন বার্সেলোনা শুধু একটি ফুটবল ক্লাব নয়, ফুটবল ক্লাবের চাইতেই যেন বেশী কিছু।‘ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু’- ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব বার্সেলোনা এই শ্লোগানটি ব্যবহার করা শুরু করেছে ১৯৬৮ সাল থেকে। কিন্তু কাগজে-কলমে লেখা না থাকলেও বার্সেলোনা ক্লাবের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠালগ্নের শুরু থেকেই।১৮৯৯ সালে ক্রীড়াপ্রেমী জন গ্যাম্পারের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা ফুটবল ক্লাবটি কালক্রমে পরিণত হয়েছে মহীরুহতে। ফুটবল দুনিয়ায় সাফল্য আর ক্রীড়ানৈপুণ্যের বিচারে বার্সেলোনাকে নিশ্চিতভাবেই রাখা যায় প্রথম সারিতে। তবে শুধু ফুটবল মাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি কাতালোনিয়ার এই ক্লাবটি। হয়ে উঠেছে একটি জাতিসত্তার অনুভব-অনুভূতি প্রকাশের মঞ্চ। সত্যিই বার্সেলোনা ক্লাবের চেয়ে অনেক বেশি কিছু।অনেকেই বলেন খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতির মিশেল ঘটানো ঠিক না। কিন্তু বার্সেলোনার ক্ষেত্রে কথাটি মানতে গেলে আড়ালেই থেকে যাবে ক্লাবটির বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। শুধু ফুটবল মাঠ-ই না, স্পেনের রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনেও বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের সরব উপস্থিতি ছিল এবং এখনও আছে। শুধুই এতো শত তথ্য জুড়ে রয়েছে এই ক্লাবের সাথে? না।
সমর্থক হিসেবে বার্সেলোনা ক্লাব সমর্থন করার পর থেকে আমাকে সবচেয়ে খুশী করেছিলো ২০১৫ সালের ট্রেবল, মেসি – নেইমার – সুয়ারেজ জুটি। ২০১৫ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনাল থেকে পরাজয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে জুভেন্টাস। ৩-১ গোলে ইতালির ক্লাবটিকে হারিয়ে পঞ্চমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগের শিরোপা ঘরে তুলেছে বার্সেলোনা।বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে উত্তেজনাকর ম্যাচে চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা জিতে এক মৌসুমের তিনটি শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব স্থাপন করলেন মেসি-নেইমাররা। এর আগে চলতি মৌসুমে কোপা দেল রে ও লা লিগা জিতেছে এই স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাবটি। এক মৌসুমে তিনটি ট্রফি জয়ের রেকর্ড একাধিক দলের আছে, কিন্তু দু’বার এই বিরল কৃতিত্ব দেখানোর নজির বার্সাই প্রথম স্থাপন করেছিলো৷ ৫ম বারের মতন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে বায়ার্ন মিউনিখ আর লিভারপুলের পাশে নাম লেখিয়েছিলো বার্সেলোনা৷ আনন্দ এলে ও জাভির বিদায় মনকে করেছিলো নরম, পেয়েছিলাম বেদনার সুর , এরপর থেকে চ্যাম্পিয়নস লীগের ট্রফি অধরা থাকলে ও ছোঁয়া হয়েছিলো লা লীগা, কোপা দেল রে ট্রফি৷
জাভি চলে যাওয়ার পর প্রতিটি বার্সেলোনা সমর্থকদেরকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছে নেইমার, নেইমারের চলে যাওয়ায় ভক্ত – সমর্থকেরা পেয়েছে কষ্ট।এর আগে চ্যাম্পিয়নস লীগের ১ম লেগে পিএসজির কাছে হালি গোল খেয়ে ও ২য় লেগে নিজেদের করে নিয়েছিলো বার্সেলনা। নেইমারের দৃষ্টি নন্দন ফ্রি-কিক যেনো আজ ও চোখে ভাসে৷ এরপর একটা ক্রস, একটা ফ্লিক, সার্জিও রবার্তোর বাড়িয়ে দেয়া বুট, বলের জালে জড়ানো, পিএসজি’র খেলোয়াড়দের হাঁটু ভেঙে মাঠে শুয়ে পড়া। বার্সেলোনা ডাগ-আউটের মাঠে ছুটে যাওয়া। লিওনেল মেসির বিজ্ঞাপনী বোর্ডে উঠে দাঁড়ানো এবং ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে মানুষের স্রোতে ঢলে পড়া। এই স্বপ্নের গল্প তো শুরুতেই বলা হয়েছে। এরপর একদিন ইনিয়েস্তা ও গুড বায় জানালো বার্সাকে। দলে এখন সুয়ারেজ নেই রাকিটিচ ও নেই।
আমাদের মতো ছোট ছোট সাধারণ সমর্থকদের ভালোবাসায় উপরেই থাকুক পছন্দের ফুটবল দল ” ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা”।
Leave a Reply