স্পোর্টস ডেস্কঃ “বিস্ময় ” এ শব্দটা দ্বারাই বুঝতে পারি আমরা অবাক করা কিছু, যেন তাক লাগিয়ে দেয়া, যেন অবিশ্বাস্য। আমাদের ও একজন বিস্ময় বালক আছে৷ যেন তিনি দেশের ক্রিকেটে এসেছিলেন এক বিস্ময়কর ধ্রুবতারা হিসেবে৷ ক্রিকেট বল হাতে জাদু দেখিয়ে কিভাবে মানুষকে বিস্ময়ে ফেলা যায় এটাই হয়তো দেখিয়েছিলেন তিনি৷ আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে মিরপুরে টসের আগে পিচ দেখে দলের কান্ডারি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো চার পেসার নিয়ে একাদশ সাজানোর৷ ঠিক যেই কথা সেই কাজ৷ আর ফলাফলতো এলো ২২ গজের মাঠেই। মিরপুরে ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচেই ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের নাকানিচুবানি খাইয়ে নিজের পকেটে নিয়ে নেন পাঁচ উইকেট। অভিষেক ম্যাচেই পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যাচের ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি। এখানেই তো সেদিন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো তিনি, সবাইকে দিলো চমক যেন সবাই বিস্ময়।
মুস্তাফিজুর রহমানের জন্ম সাতক্ষীরায়, ১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সাতক্ষীরা থেকে ৪৫ কি.মি. দক্ষিণে তেঁতুলিয়া গ্রামে মুস্তাফিজের বাড়ি। চার ভাই আর দুই বোনের মাঝে সবার ছোট তিনি। আর দশটা পরিবারের মত মধ্যবিত্ত এক পরিবারেই জন্ম নেন মুস্তাফিজ। জন্মের পরপরই বাবা-মা ঠিক করে ফেললেন তার ছেলেকে হয় ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন। পরিবারের সম্মান উঁচুতে তুলবেন মুস্তাফিজ। কিন্তু লেখাপড়ার চাইতে তিনি যেনো মনোযোগী বেশী খেলাধুলাতে। সুযোগ পেলেই নেমে যেতো ক্রিকেট খেলতো৷ শেষ পর্যন্ত পরিবারের সম্মান শুধু উঁচুতে নয় রাজসিংহাসনে তুলেছেন মুস্তাফিজ। কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে নয়, এক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে। আমরা আজ জানবো মুস্তাফিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার নিয়ে।
মুস্তাফিজুর রহমানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারঃ নিজ বাড়ি থেকে প্রতিদিন সকালে ৪০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত তিনি পাড়ি দিতেন। যার কারণে স্কুলে আর ক্লাস করা হচ্ছিলো না। বোলিং এর জন্য নিজের অনুপ্রেরণা ছিলেন মোহাম্মদ আমীর৷ বিস্ময় বালকের অভিষেকেই যেন সবাইকে জানান দিয়েছিলো তিনি সত্যিই বিস্ময় বালক৷ পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি, ভারতের সঙ্গে ওয়ানডে আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট—ক্রিকেটের তিন সংস্করণের আন্তর্জাতিক অভিষেককেই অসাধারণ সাফল্যে রাঙিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। ২৪ এপ্রিল ২০১৫, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুস্তাফিজের প্রথম ম্যাচ। প্রথম ম্যাচে মানেই স্নায়ুচাপ। কিন্তু মুস্তাফিজ তা গায়ে মাখলে তো? মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমে তাঁর হাতেই বল তুলে দিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। নিজের প্রথম উইকেট হিসেবে তুলে নিয়েছিলো শহীদ আফ্রিদিকে।অভিষেকে বোলিংটা এমন : ৪-০-২০-২। ডট বলই ১৬টা! একটাও চার খাননি। তাঁর বলে একমাত্র ছক্কাটি মেরেছেন আফ্রিদির। এরপর ওয়ানডেতে মিরপুরে ১৮ জুন ২০১৫ তারিখটাও ‘দ্য ফিজে’র কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই।মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতকে ৩০৮ রানের লক্ষ্য দিল বাংলাদেশ।৫০ রানে ৫ উইকেট—বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডে অভিষেকে দ্বিতীয় সেরা বোলিং। পেলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও। গত বছরের ২১ জুলাই চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক মুস্তাফিজের। প্রথম ১৩ ওভারে উইকেটশূন্য। সে টেস্টে ফিজের ছিলো হ্যাটট্রিক এর সুবর্ণ সুযোগ। অভিষেক টেস্টে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। ওয়ানডে অভিষেকেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ওয়ানডে ও টেস্ট দুই ধরনের ক্রিকেটে অভিষেকেই ম্যাচসেরা হওয়ার প্রথম কীর্তি মুস্তাফিজেরই।
মুস্তাফিজকে মূলত মাটিতে নামিয়ে আনে এক বেরসিক ইনজুরি। ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ব্লাস্ট খেলতে। সেখানে কাঁধের ইনজুরিতে পড়েন, মাঠ থেকে দূরে থাকেন পাক্কা আট মাস। বাংলাদেশের ক্রিকেট সার্কিটে গুঞ্জন ছিল, মাত্রাতিরিক্ত ক্রিকেট খেলাটাই মুস্তাফিজের ইনজুরির কারণ।ইনজুরিতে পরার আগে সাদা বলের ক্রিকেট তিনি খেলেছিলেন ২২টি। তাতে ১৩.০৮ গড়ে পান ৪৮ উইকেট। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি ফিরে প্রথম ৩২টি উইকেট নিতেই গড়টা দ্বিগুন হয়ে যায়।আইপিএলেও চিত্রটা একই রকম ছিল। প্রথম মৌসুমে ১৭ উইকেট পান ২৪.৭৬ গড় আর ৬.৯০ ইকোনমি রেটে। অথচ, ২০১৮ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে পান কেবল সাত উইকেট, গড় ৩২.৮৫। ইকোনমি ওভার প্রতি প্রায় ১.৫ বেড়ে যায়।
জুনে, ভারত একটি টেস্ট এবং তিনটি ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশ সফর করেছিল। ওয়ানডে দলে নির্বাচিত হন রহমান। সিরিজের তার প্রথম ম্যাচে রহমান প্রথম ম্যাচে ২.২ ওভারে পাঁচ উইকেট শিকার করে শক্তিশালী ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে তার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতেছিল এবং রহমান ওডিআইয়ের ইতিহাসে দশম বোলার হয়ে অভিষেকের পথে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন।দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মুস্তাফিজুর রহমান আরও ছয় উইকেট নিয়েছিলেন।জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভিটোরির আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে এটি দুটি ওয়ানডের পর যে কোনও বোলারের সর্বাধিক উইকেটের রেকর্ড অর্জন করতে সহায়তা করেছিল। তিনি সর্বশেষ ওয়ানডেটি ২ উইকেট দিয়ে শেষ করেছেন এবং তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১৩ উইকেট নিয়ে ইতিহাস গড়েন।পরের মাসে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিততে বাংলাদেশ তিনটি ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নিয়েছিল। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম একই সিরিজে টেস্ট অভিষেক যেখানে তিনি ৪ উইকেট শিকার করেছিলেন৷
ইনজুরি যখন ক্যারিয়ারে ধাক্কা খেয়ে আসে মুস্তাফিজের : নভেম্বর মাসে, জিম্বাবুয়েকে তিনটি ওয়ানডে এবং দুটি টি-টোয়েন্টিতে স্বাগতিক করেছিল বাংলাদেশ। ওয়ানডে ম্যাচে মুস্তাফিজুর রহমান মোট আটটি উইকেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০১৫ সালে তার পারফরম্যান্সের জন্য, তাকে আইসিসি দ্বারা বিশ্ব ওয়ানডে একাদশে স্থান দেওয়া হয়েছিল।ইএসপিএনক্রিকইনফো এবং ক্রিকবাজ ২০১৫ সালের ওয়ানডে একাদশেও তাঁর নাম ঘোষণা করেছিলেন। তিনি শেষ খেলায় নিজের তৃতীয় পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন। তিনি টি-টোয়েন্টি সিরিজে খুব বেশি অবদান রাখতে পারেননি, যদিও তিনি ইকোনোমিকভাবে বোলিং করেছিলেন, যার ফলস্বরূপ উভয়পক্ষই একটি জয় ভাগ করে নিয়েছে। পরের বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ আবার জিম্বাবুয়ের সাথে চারটি টি-টোয়েন্টিতে খেলেছিল। মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম দুটি ম্যাচ খেলেছিলেন, যা তারা জিতেছিল। ২০১৬ জানুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে বোলিংয়ের সময় মুস্তাফিজুর তার কাঁধে আঘাত করেছিলেন। তারপরে, অভিষেকের পর তাকে প্রথমবারের মতো স্কোয়াড থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
পরের মাসে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ চলাকালীন, তার পাশের স্ট্রেনের কারণে তাকে আবারও দল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল,প্রথম তিনটি ম্যাচই খেলেছিলেন। মার্চ মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে তিনি অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে পেরেছিলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে পাঁচ উইকেট শিকারের পরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে পাঁচ উইকেট শিকারকারী তিনিই প্রথম বাংলাদেশি বোলার। তিনটি ম্যাচে তিনি মোট 9 উইকেট নিয়েছিলেন। আইসিসি ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য ‘টুর্নামেন্ট অফ দ্য টুর্নামেন্টে’ দ্বাদশতম ব্যক্তি হিসাবে তাকে নাম দিয়েছে।
ডিসেম্বর ২০১৬ and এবং জানুয়ারী ২০১৭ সালে সিরিজ চলাকালীন বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ড সফর করলে ও মুস্তাফিজ আবার সব ম্যাচ খেলতে পারেননি।] তিনি ২০১৫ সালের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গালিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে আটটি উইকেট নিয়ে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। এপ্রিল ২০১৮ সালে, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) দ্বারা ২০১৮ মৌসুমের আগে কেন্দ্রীয় চুক্তিতে ভূষিত হওয়া দশ ক্রিকেটারের মধ্যে একজন ছিলেন। ২৯ মে ২০১৮ এ, আঙ্গুলের চোটের কারণে আফগানিস্তানের বিপক্ষে আসন্ন তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে রহমানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। দেখতে দেখতে ২০১৯ সালে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপের জন্য উড়াল দিলো ইংল্যান্ডে৷ সেখানে তিনি বিশ্বকাপ শেষে ছিলেন উইকেট টেকারদের মধ্যে ২য়। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুস্তাফিজ বিশ্বকাপে মোট ৭২.১ ওভার বল করে ২০ উইকেট নিয়ে রান দিয়েছেন ৪৮৪। সেরা বোলিং ছিল পাঁচ উইকেট দিয়ে ৫৯ রান। এছাড়া তাঁর ইকোনমি রেট ৬.৭০। বিশ্বকাপে নিজের শেষ দুই ম্যাচে নিয়েছিলো পাঁচ পাঁচ করে ১০টি উইকেট। ভারতের বিপক্ষে পাঁচটির পর তুলে নিয়েছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচটি উইকেট তাও ঐতিহাসিক লর্ডসের মাটিতে। যেন সেই নিজের সাতক্ষীরা থেকে কাঁপিয়েছেন লর্ডস৷
তুমি যে আছো তাই, আমি পথে হেঁটে হেঁটে যাই
হেঁটে হেঁটে বহুদূর, বহুদূর যেতে চাই
টিপ টিপ পা ফেলে দেশকে উপহার দিক আর ও স্বর্ণালি মুহূর্ত৷ লাল সবুজের সমর্থকদের আর ও দেখিয়ে দিক নিজের বিস্ময়কর কাজ৷
Leave a Reply