টেক ডেস্কঃ আমরা যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করি, তারা নিশ্চয়ই কুকিজ শব্দটার সাথে পরিচিত! সচারাচরই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ‘Accept Cookies’ নামের বিভিন্ন বাটন দেখতে পাওয়া যায়, যার বেশীরভাগই মূলত ‘থার্ড পার্টি’ কুকিজ বিষয়ক। তো এই কুকিজ বা থার্ড পার্টি কুকিজ আসলে কি?
আগেই জেনে রাখুন যে এই কুকিজ কিন্তু খাওয়ার কুকি (বিস্কুট) নয়! সহজভাবে বলতে গেলে, কুকিজ আসলে কিছু ফাইল, যেগুলো আপনার ইন্টারনেট ব্রাউজারের ক্যাশ মেমোরিতে সংরক্ষিত হয়। আর এই ফাইলগুলো আসে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে। যখনই আপনি কোন কুকি এনাবল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেন এবং আপনার ইন্টারনেট ব্রাউজারে যদি কুকি এনাবল করা থাকে তবে সেই ওয়েবসাইট টি আপনার ব্রাউজার ক্যাশে কুকিজ ড্রপ করে দেয়। এই কুকিজ ফাইলগুলো বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। আজকে আমরা সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবোনা। তো ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোতে মূলত ২ ধরনের কুকিজ ব্যবহার করা হয়।
যথাঃ- (১) ফার্স্ট পার্টি কুকিজ এবং (২) থার্ড-পার্টি কুকিজ।
★ যখন কোনো কুকিজ আপনি যে ওয়েবসাইট ব্যবহার করছেন, সেই ওয়েবসাইট থেকেই আসে, তখন সেটাকে ফার্স্ট পার্টি কুকিজ বলা হয়। যেমন- ধরা যাক, আপনি কোনো মুভি ডাউনলোড করার জন্য MovieLagbe.Com এই ওয়েবসাইট-এ গেলেন এবং এই ওয়েবসাইটের কিছু সেটিংস আপনার ইচ্ছামতো সেট করে দিলেন; তো তখন ঐ ওয়েবসাইট-টি আপনার ব্রাউজারে কিছু কুকিজ দিয়ে দিবে। যেহেতু এই কুকিজগুলো আপনার ব্যবহারকৃত ঐ ওয়েবসাইট-টি থেকেই আপনার ব্রাউজারে সেইভ হলো, তাই এটাকে বলা হবে ফার্স্ট পার্টি কুকিজ।
★ এবার ধরা যাক, আপনি এমন একটা ওয়েবসাইটে ঢুকলেন যেটাতে গুগলের এডসেন্স চালু করা আছে। তো ঐ ওয়েবসাইটে ঢোকার সাথে সাথেই গুগলের পক্ষ থেকে আপনার ব্রাউজারে বেশ কিছু কুকিজ ইনজেক্ট করে দেয়া হবে। দেখুন, আপনি কিন্তু গুগলের ওয়েবসাইটে ঢোকেননি; আপনি ঢুকেছেন অন্য একটা ওয়েবসাইটে। কিন্তু, তবুও ঐ ওয়েবসাইটে ঢোকার পর আপনাকে গুগলের পক্ষ থেকে কুকিজ দেয়া হলো, এটাই হচ্ছে থার্ড-পার্টি কুকিজ।
এখন এই থার্ড পার্টি কুকিজ গুলো বিভিন্ন কারনে ব্যবহার করা হয়, এর মধ্যে অন্যতম এবং প্রধান কারন হলো ইউজার ট্রাকিং করা এবং ওয়েবসাইট ভিজিটরদের টার্গেটেড এড দেখনো। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, আপনি ইন্টারনেটের যে ওয়েবসাইটেই যান না কেনো, সেখানে গুগলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম এড দেখানো হয়, এবং বেশীরভাগ এডই আপনার পছন্দ-সই! এটা মূলত করা হয় ইউজার ট্রাকিং মেথডের মাধ্যমে থার্ড-পার্টি কুকিজ ব্যবহার করে।
যেহেতু এই থার্ড পার্টি কুকিজ বেশীরভাগ সময়ই ট্রাকিং এ ব্যবহৃত হয়, তাই এটি প্রাভেইসির জন্য একটা মারাত্মক সমস্যা। একারনে প্রাভেইসি ফোকাসড সব ব্রাউজারগুলোতে ডিফল্টভাবে থার্ড-পার্টি কুকিজ বন্ধ করে দেয়া থাকে। যেমনঃ মজিলা ফায়ারফক্স, ব্রেইভ ব্রাউজার, সাফারি ইত্যাদি।
শুরুর দিকে শুধু প্রাভেইসি ফোকাসড ব্রাউজার গুলো ডিফল্টভাবে থার্ড-পার্টি কুকিজ বন্ধ করে দিলেও, আস্তে আস্তে মোটমুটি সব ব্রাউজারই বাই ডিফল্ট এটি বন্ধ করে দেয়, শুধুমাত্র ‘গুগল ক্রোম’ ছাড়া! কিন্তু যেহেতু শুধুমাত্র ক্রোমই বাই ডিফল্ট থার্ড-পার্টি কুকিজ চালু করে রাখে, তাই রেগুলেটরি পার্টি এবং ইন্টারনেট কমিউনিটি থেকে গুগলকে এর জন্য প্রচুর সমালোচনার শিকার হতে হয়। অনেকটা বাধ্য হয়েই গুগল ঘোষণা করে ২০২২ সাল থেকে তারাও ক্রোমে বাই-ডিফল্ট থার্ড পার্টি কুকিজ ডিজেবল করবে।
কিন্তু, গুগলের জন্য এই পদক্ষেপ তো নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারার মতো! কারন, গুগলের মোট লাভ্যাংশের ৫০ শতাংশ-ই আসে টার্গেটেড এডস থেকে এবং এই টার্গেটেড এডের বেশীরভাগই থার্ড পার্টি কুকিজ ব্যবহার করে করা হয়। আবার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরদের প্রায় ৮০%-ই ক্রোম ব্রাউজার ব্যবহার করে, তাই এতদিন বাকি ব্রাউজারগুলো থার্ড-পার্টি কুকিজ বন্ধ করে রাখলেও তাতে গুগলের বিশেষ কিছু এসে-যাচ্ছিলো না। কিন্তু স্বয়ং গুগল যদি ক্রোম ব্রাউজারে এটা করে, তাহলে সেটা তো গুগলের জন্যই অনেক বড় ক্ষতি!
কিন্তু, গুগল তো গুগল-ই! তারা কি আর নিজের ক্ষতি নিজেই করতে পারে? থার্ড-পার্টি কুকিজ বন্ধ করার ঘোষণা দেবার কিছুদিন পরেই গুগলের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো তারা এখন থেকে থার্ড-পার্টি কুকিজ এর পরিবর্তে ‘FLoC’ বা ‘Federated Learning of Cohorts’ ব্যবহার করবে!
★ এখন এই FLoC আসলে কি?
FLoC সম্পর্কে গুগল বলছে- “এটি কুকিজের থেকে অনেক বেশী প্রাভেইসি ফোকাসড ট্রাকিং সিস্টেম।” কিন্তু অন্যরা বলছে- “একেবারেই না, এটি শুধুমাত্র গুগলের মনোপলি-কে আরও বেশী শক্তিশালী করবে।”
FLoC এর পিছনের কনসেপ্টটা আসলে অনেকটা এমন যে- ‘ইউজাররা পছন্দ করে না বিভিন্ন ওয়েবসাইট তাদেরকে ট্রাক করুক, বিশেষত যখন এডভারটাইজাররা থার্ড-পার্টি কুকিজের মাধ্যমে তাদের গোটা ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর নজরদারি চালায়!’ সুতরাং গুগল বললো- ‘কোনো সমস্যা নেই, আমরা ইউজারদের ওয়েবসাইট ট্রাকিং থেকে মুক্তি দিতে FLoC নিয়ে এসেছি, এখন থেকে কোনো ওয়েবসাইটই কোনো ইউজারকে কুকি দ্বারা ট্রাক করবেনা, এর পরিবর্তে আমাদের গুগল ক্রোম ব্রাউজার থেকেই ইউজারদের ট্রাক করা হবে! স্বয়ং ক্রোম ব্রাউজার চেক করবে ইউজার ইন্টারনেটের কোন কোন ব্রাউজারে ভিজিট করে, সেই ওয়েবসাইটগুলোতে কি কি করে এবং ইউজারদের সমস্ত এক্টিভিটি মেশিন-লার্নিং এর মাধ্যমে এনালাইসিস করে ইউজারের কোন কোন বিষয়ে আগ্রহ তা বের করবে।
যেমন- হতে পারে একজন ইউজারের কার নিয়ে খুব আগ্রহ, গুগল ক্রোম এনালাইসিস করে এটা বের করবে, তারপর গুগল এরকম আরও যত কার নিয়ে আগ্রহী ইউজার আছে, তাদের নিয়ে একটা গ্রুপ করবে আর এই একই পছন্দের ইউজার গ্রুপকে বলা হবে ‘Cohort’. তারপর ঐ স্পেসেফিক Cohort এর একটা ইউনিক আইডি সেট করে দেয়া হবে। এরপর থেকে একজন ইউজার যখনই কোনো ওয়েবসাইটে ভিজিট করতে যাবে, গুগল ঐ ওয়েবসাইট-কে ঐ Cohort ID (Group ID) দিয়ে দিবে, যেখান থেকে ওয়েবসাইট ঐ স্পেসেফিক ইউজার গ্রুপের ইন্টারেস্ট অনুযায়ী ইউজারকে পার্সোনালাইজড এড দেখাবে।
সহজ কথায়, FLoC হলো এমন একটা সিস্টেম, যেটার মাধ্যমে, আপনি যে ওয়েবসাইটে ভিজিট করেন সেই ওয়েবসাইটের কুকিজ দিয়ে আপনাকে ট্রাক করার পরিবর্তে স্বয়ং ব্রাউজার দিয়েই আপনাকে সবসময় ট্রাক করা হবে! এবং এটিই হলো FLoC এর মেইন কনসেপ্ট। কিন্তু এর মাধ্যমেও তো ইউজারকে আগের মতোই (কিংবা আগের চেয়েও বেশী!) ট্রাক করা হলো, তাহলে-
★ গুগল FLoC কে প্রাভেইসি ফোকাসড অলটারনেটিভ বলছে কেনো?
আসলে এখানেই গুগলের ভন্ডামী! কুকিজ দিয়ে আলাদা ওয়েবসাইটে আপনাকে ট্রাক করতে হলে আপনার পারসোনাল ডেটা ব্যবহার করা হতো, কিন্তু FLoC এর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ব্যক্তির ডাটা ব্যবহার না করে, ‘একই রকম পছন্দ’ এমন ব্যক্তিদের ‘গ্রুপ ডাটা’ ব্যবহার করা হবে। যেহেতু এখানে কোনো ব্যক্তি বিশেষের ডাটা ওয়েবসাইটে যাচ্ছেনা, বরং একটা গ্রুপের ডাটা যাচ্ছে, তাই গুগল এটাকে আখ্যায়িত করেছে প্রাভেইসি ফোকাসড ‘থার্ড-পার্টি কুকিজ’ অলটারনেটিভ হিসেবে!
★ এখন প্রশ্ন হলো FLoC আসলেই প্রাভেইসি ফোকাসড কিনা?
সহজ উত্তর হলো- “একেবারেই না!”গুগল ওয়েবসাইটকে যে Cohort ID দেয় সেটা দিয়ে একজন ইউজারের আইডেন্টিটি বা একটিভিটি হিস্ট্রি জানা না গেলেও, যখন এই Cohort ID এর সাথে ইউজারের আইপি এড্রেস যোগ করা হয় (যেটা প্রতিটা ওয়েবসাইট অবশ্যম্ভাবীভাবেই পেয়ে যায়), তখন খুব সহজেই ঐ স্পেসেফিক ইউজারের আইডেন্টিটি এবং পারসোনালাটি, একটিভিটি হিস্ট্রি বের করে ফেলা যায়।
★ FLoC এর সমস্যা/সমালোচনাঃ
• প্রথমত, FLoC এর প্রধান সমস্যা হলো এর মাধ্যমে স্বয়ং ব্রাউজার থেকে আপনাকে সর্বক্ষন, সব ধরনের ওয়েবসাইটে ট্রাক করা হবে। অথচ আগে, শুধুমাত্র ঐসব ওয়েবসাইটেই আপনাকে ট্রাক করা হতো যেগুলোতে গুগল এড চালু করা থাকতো। সুতরাং তখন গুগল আপনাকে সকল ওয়েবসাইটে সবসময় ট্রাক করতে পারত না, কিন্তু এখন গুগল সব ওয়েবসাইটেই আপনাকে ট্রাক করতে পারবে।
• দ্বিতীয়ত, থার্ড-পার্টি কুকিজ বন্ধ করে, গুগল তার নিজেরই এবং বিশ্বের সবচেয়ে পপুলার ব্রাউজারকেই একটা অলওয়েজ ট্রাকার হিসেবে রূপান্তরিত করলো, যেটা গুগল বাদের বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো এড নেটওয়ার্কের জন্য একটা মারাত্মক হুমকি। এর ফলে ইন্টারনেটে শুধুমাত্র গুগলই একমাত্র এড প্রোভাইডার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, অন্যরা হারিয়ে যাবে।
• তৃতীয়ত, FLoC কে গুগল ক্রোমে ইন্ট্রিগেট করার ফলে ওয়েবসাইটগুলো আরও বেশী গুগল ক্রোম ভিত্তিক হয়ে যাবে, অন্যান্য ব্রাউজারে হয়ত ওয়েবসাইটগুলো ততটা ভালো কাজ/পারফর্ম করবেনা, যেটা ব্রাউজার মার্কেটে গুগলের মনোপলি-কে আরও বেশী পাকাপোক্ত করবে।
• চতুর্থত, গুগল ক্রোম ব্রাউজারে এই FLoC যুক্ত করেছে ইউজারকে একদম না জানিয়েই। এমনকি গুগল এমন ব্যবস্থাও করে রেখেছে, যাতে ইউজাররা এবং ওয়েবসাইট ওনাররা চাইলে এটাকে সহজে বন্ধও করতে না পারে!! অর্থাৎ এটি অনেকটা ব্যবহার করতে বাধ্য করার মতো, এবং এক্ষেত্রে গুগলের আচরন অনেকটা এমনই যেনো – “HEY, WE RUN THE INTERNET, Accept it or don’t use Internet at all! “
★ FLoC নিয়ে অন্যান্যদের মতামত এবং এটি থেকে বাঁচার উপায়ঃ
গুগল যতই FLoC কে যতই বেটার অলটারনেটিভ বলুক না কেনো, প্রাভেইসি ফোকাসড অরগানাইজেশান এক কথায় এর উত্তর দিয়ে দিয়েছে। আর সেটা হলো – “Hell! Nooooooo!!”
ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন এর মতে – “Google’s FLoC Is a Terrible Idea”. ডাক-ডাক-গো বলছে – “FLoC Is Bad For Privacy”. Mozilla FireFox, Brvae এবং Vivaldi, তিন প্রাভেইসি ফোকাসড ব্রাউজার ইতিমধ্যেই এনাউন্স করছে তারা তাদের ব্রাউজারে FLoC যুক্ত করবেনা এবং বাকিরাও খুব দ্রুতই ঘোষণা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এখন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে এই FLoC এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে?
এক কথায় উত্তর হচ্ছে, “গুগল ক্রোম ব্রাউজার ব্যবহার না করা, আপনি গুগল ক্রোম ব্রাউজার ব্যবহারকারী হলে এর থেকে নিস্তার নেই”আপনার যদি ক্রোম খুব ভালো লাগে, তাহলে Brave কিংবা ওপেন-সোর্স Chromium ব্যবহার করুন। এগুলো হুবহু ক্রোমই, কিন্তু ক্রোমের সকল খারাপ দিক বাদ দিয়ে! আর আপনি ফিচার এবং অনেক সুবিধাসমৃদ্ধ ব্রাউজার চাইলে Vivaldi ব্রাউজার ব্যবহার করুন। আর আপনি যদি আরও বেশী প্রাভেইসি চেয়ে থাকেন, তাহলে Mozilla Firefox ব্যবহার করুন! আপনি যা ইচ্ছা ব্যবহার করুন, কিন্তু ‘Google Chrome’ ব্যবহার করবেন না।
পরিশেষে একটাই কথা, ইন্টারনেট জগতটা বড় বড় মনোপলিস্টিক প্রতিষ্ঠান গুলোর হাত থেকে মুক্তি পাক, ইন্টারনেটটা ঠিক ততটাই ওপেন হোক, যতটা ওপেন করে এটাকে তৈরি করা হয়েছিলো, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং অধিকার বরাদ্দ থাকবে। আর সাধারণ ব্যবহারকারীরা আরও বেশী সচেতন হোক, তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিয়ে আরও বেশী সোচ্চার হোক, এটিই সবথেকে বড় প্রত্যাশা।লিখেছেনঃ আরিফুজ্জামান রিপন
Leave a Reply