স্পোর্টস ডেস্কঃ সময়টা ২০১৩, তখন ক্লাস ৫ কিংবা ক্লাস ৬ থেকে ভিনগ্রহের মেসির ম্যাজিকেল মেসির সেই জাদুকরী ফ্রি-কিক না দেখলে হয়তো তাকে কিংবা বার্সাকে কাউকেই আজীবনের জন্য সাপোর্ট করতাম না। এর আগেই ব্যাক্তিগতভাবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আমাকে মুগ্ধ করলে ও কেন জানি মেসির সেই ম্যাজিকেল ফ্রি-কিক কিংবা বা পায়ের তার সেই ম্যাজিকেল টাচ আমাকে শুধু মুগ্ধ, বিস্ময়, অবাক করতো। কিন্তু কেনো এভাবে সে কিংবা তার দল বার্সা আমাকে মুগ্ধ, বিস্ময় কিংবা আমার পছন্দ হতো তা আজ ২০২০ এসে ও আমার জানা নেই। অথচ এর আগে ইউরোপের সেরার মঞ্চে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে ২০১৫ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো বার্সেলোনা। এরপরে পাঁচ পাঁচটি বসন্ত চলে গেলে ও চ্যাম্পিয়নস লীগের মুকুট যেন ছিনিয়ে আনতে পারলো না বার্সা। তো, কাপ নিবে না, ম্যাচ জিতবে না, কিংবা হালি হালি গোল খাবে আমরা সাপোর্ট না করে দল বদলিয়ে অন্য ক্লাবকে সাপোর্ট করবো? না, হয়তো এই কাজটা আমার দ্বারা অসম্ভব।
সময়টা ২০১৫ সাল। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে মুখোমুখি বার্সেলোনা বনাম জুভেন্টাস। মিডফিল্ড থেকে মেসির পাস জর্ডি আলভার উদ্দেশ্যে, আলভা থেকে নেইমার গ্যাপ পেয়ে নেইমার খুঁজে নিলো ইনিয়েস্তাকে এবং ইনিয়েস্তার পাস ধরে বড় চুলের ইভান রাকিটিচের গোল। এরপর রাকিটিচের পাস ধরে মধ্য মাঠ থেকে মেসি বল নিয়ে ডি-বক্সের কাছাকাছি থেকেই নিলেন শট, গোলরক্ষক বুফন বল সামলাতে না পারলে ও ফিরতি বলে গোল করেন সুয়ারেজ। ম্যাচের শেষ সময়ে ডিফেন্সিভ মিড থেকে নেইমারের উদ্দেশ্য বল বাড়ান মেসি পরবর্তীতে নেইমার বদলি খেলোয়াড় পেড্রোর সাথে রসায়নে ম্যাচের শেষ গোল করেন এবং চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো বার্সা৷ আহা, ইনিয়েস্তা – জাভি, লম্বা চুলের রাকিটিচ, কিংবা সিনিয়র ম্যাশ্চেরানো, এটাকিং এ মেসি- নেইমার – সুয়ারেজ। কিন্তু বর্তমান দলটার ক’জন খেলোয়াড় বার্সেলোনাকে এগিয়ে নিতে পারবে? যেখানে দলের ৭-৮ জন খেলোয়াড় এর বয়সই ৩০ এর বেশী।
২০১৫ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে বার্সার রেকর্ডঃ
– প্রথম ইউরোপিয়ান দল হিসেবে দুইবার ট্রেবল জিতলো বার্সেলোনা (২০০৮-০৯ আর ২০১৪-১৫)। অন্য যেসব ইউরোপিয়ান দলের এই কীর্তি আছে : সেলটিক (১৯৬৬-৬৭), আয়াক্স (১৯৭১-৭২), পিএসভি আইন্দোহোভেন (১৯৮৭-৮৮), ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড (১৯৯৮-৯৯), ইন্টার মিলান (২০০৯-১০), বায়ার্ন মিউনিখ (২০১২-১৩)।
– ৫ম বারের মতন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে বায়ার্ন মিউনিখ আর লিভারপুলের পাশে নাম লেখালো বার্সেলোনা। এরচেয়ে বেশি শিরোপা আছে রিয়াল মাদ্রিদ (১০ বার) আর এসি মিলানের (৭বার)।
– প্রথম দল হিসেবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে চ্যাম্পিয়ন হবার পথে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, ইতালিয়ান সিরি-আ, জার্মান বুন্দেসলীগা, ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়নদের হারিয়েছে বার্সেলোনা। গ্রুপ পর্যায়ে সাইপ্রাস লীগ আর ডাচ লীগ চ্যাম্পিয়নদেরও হারিয়েছিলো বার্সেলোনা।
– সবচেয়ে বেশিবার (৬বার) উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে রানার্স আপ হলো জুভেন্টাস। ৫ বার করে রানার্স আপ হয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ আর বেনফিকা।
– প্রথমবারের মতো কোনো দলের দুইজন খেলোয়াড় (বার্সেলোনার মেসি-নেইমার) চ্যাম্পিয়নস লীগের একই মৌসুমে ১০ গোল করলেন।
– মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ ত্রয়ী মিলে ২০১৪-১৫ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে করেছেন মোট ১২২ গোল। প্রথম দল হিসেবে দুইবার ট্রেবল জেতা ক্যাটালানদের ১৭৫ গোলের প্রায় ৭০ শতাংশ গোল এসেছে লাতিন আমেরিকার সেরা তিন তারকার কাছ থেকে। (মেসি ৫৮, নেইমার ৩৯, সুয়ারেজ ২৫)
– উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে সবচে বেশিবার মাঠে নামার রেকর্ড গড়লেন বার্সেলোনার জাভি (১৫১ ম্যাচ)। পরের মৌসুমেই হয়ত ক্যাসিয়াস (১৫০ ম্যাচ) আবার রেকর্ডটি ভেঙ্গে দিবেন।
– ১৯৮৯ আর ১৯৯০ সালের পর এই প্রথম পরপর দুই বছর একই দেশের ক্লাব ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হলো। ২৫ বছর আগে সেই দুইবারই এসি মিলান চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অবশ্য।
– প্রথম উরুগুইয়ান খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতলেন লুইস সুয়ারেজ।
– প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইন্যালে (২০০৯, ২০১১, ২০১৫) ‘অ্যাসিস্ট’ করেছেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা।
– ক্লারেন্স সিডর্ফের পর মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে তিনটি ভিন্ন দলের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইন্যাল খেললেন প্যাট্রিস এভরা (মোনাকো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, জুভেন্টাস)। সিডর্ফ খেলেছিলেন আয়াক্স, রিয়াল মাদ্রিদ আর এসি মিলানের হয়ে। সিডর্ফের যেখানে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার রেকর্ড আছে, এভরার রয়েছে বিপরীত অভিজ্ঞতা। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে রানার্স আপ হওয়া একমাত্র খেলোয়াড় তিনি।
– পঞ্চমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লীগ আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন লিওনেল মেসি। জার্ড মুলার সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন চারবার।
এর আগে ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস লীগে নিজেদের মাঠে বায়ার্ন মিউনিখ তারা বার্সেলোনাকে হারায় ৪-০ গোলে। নিজেদের মাঠে প্রবল দাপটের পাশাপাশি বার্সেলোনা যেন মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলো না। ইনজুরির কারণে মেসি সেমি ফাইনাল খেলতে পারেননি। বার্সেলোনাও ১৮০ মিনিটের ভেতর প্রতিটি মিনিটে হারে হারে টের পেয়েছে তার অনুপস্থিতি।বায়ার্ন মিউনিখ শুধুমাত্র তাদের মাঠে ৪-০ গোলে হারিয়ে থেমে যায়নি। ক্যাম্প ন্যুতেও বার্সেলোনাকে তারা গোল করা থেকে বিরত রেখে তাদের জালে ৩ গোল করে। দুই লেগে ৭-০ গোলের এ হার ছিলো বায়ার্ন মিউনিখের বিপরীতে গত ১৫ বছরের ভেতর সবথেকে লজ্জাজনক হার।
বার্সেলোনার দুর্বলতা থেকে সেই ম্যাচে রোমার আত্মবিশ্বাসই এগিয়ে থাকবে। টানা ম্যাচ খেলায় রোমার সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় ম্যাচে বার্সেলোনার একাদশ কিছুটা ক্লান্ত ছিলো। তার উপরে তাদের পেয়ে বসেছিলো প্রথম লেগে জয়ের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। আর এসব দিক লক্ষ্য রেখেই মাঠে নেমেছিলো রোমা। তাই তাদের কঠিন মনোবলের সামনে ক্লান্ত বার্সেলোনা ছিলো অসহায়।ক্যাম্প ন্যুতে ভালভার্দের শিষ্যরা ৪ গোলের জয় পেলেও রোমা গুরুত্বপূর্ণ একটি অ্যাওয়ে গোল পেয়েছিলো বার্সেলোনার ছন্নছাড়া ডিফেন্সের কারণে। আর নিজেদের মাঠে ৩ গোলের পর তাদের সেমিফাইনালে পথ সুগম করে দিয়েছিলো ঐ ক্যাম্প ন্যুতে করা একমাত্র গোল। বার্সেলোনাকে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে গেলেও তাদের যাত্রা সেখানেই শেষ হয়ে যায়।
এখন সেই বার্সা পাঁচ পাঁচটি বসন্ত চলে গেলে ও আমাদেরকে দিতে পারে নাই উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ট্রফিখানা। মাদ্রিদ কিংবা লিভারপুল কিংবা আমি যদি ২০০৯ এর ট্রেবল জয়ী ইন্টার – মিলানের কথা বলি, তাদের ভক্ত – সমর্থেকেরা ও তাদের প্রিয় ক্লাবের পাশে আজীবনের জন্য ছিলো। কেন আমরা কাতালান সমর্থকরা কি তা পারবো না?
হ্যাঁ, আমরা ও পারবো আমাদের ক্লাবের পাশে থাকতে। ফুটবলই আমাদের কাঁদাবে আর এই ফুটবলই আমাদেরকে হাঁসাবে। ক্লাবের পাশে যদি আমরা না থাকি তাহলে কে থাকবে?
বার্সেলোনা ক্লাব ১৯৯১/৯২ আসর, ২০০৫/২০০৬ আসর, ২০০৮/২০০৯ আসর, ২০১০/১১ আসর, ২০১৪/১৫ আসরে ইউরোপ সেরার মঞ্চ উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের চ্যাম্পিয়ন হয় বার্সেলোনা। শিরোনামে দেয়া অপেক্ষার পাঁচ বছরে যেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ টানা ৩ বার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের হ্যাটট্রিক শিরোপা জয় করেছে। সেখানে আমাদের আক্ষেপ কিংবা অপেক্ষা দুটিই থাকবে। আর এই আক্ষেপ আর অপেক্ষা আমাদের অতী শীঘ্রই কাটবে৷
Leave a Reply