স্পোর্টস ডেস্কঃ গত কয়েকবছর ধরে দেশটিতে চলছিলো হত্যা, খুন, রক্ত, গৃহযুদ্ধ, বসন্তের বাতাসে ও যেনো মিলছিলো না শান্তির কোমল শীতল বাতাস। ঠিক তখনই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে সুদানকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলো আফ্রিকার এই দেশটি। যেন আনন্দে দিশেহারা গোটা দেশ, সব কিছু ভুলে গিয়ে যেনো ফুটবলের আনন্দে মেতে উঠলো গোটা জাতি।
সময় এসেছে এবার দেশের জন্য কিছু করার, জাতির জন্য কিছু করার ঠিক সে সময়ে ফুটবলার দ্রগবা যেনো অনেকটাই রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় বলেছিলে, ” এই দিনটায় ভিক্ষা চাচ্ছি আপনাদের কাছে। মুক্তি দিন আমাদেরকে,আমরা মুক্তি চাই।আমাদেরকে আনন্দে বাচতে দিন। নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। এবার অস্ত্রটা নামিয়ে ফেলুন। “বিশ্বের বড় বড় ক্ষমতাবান রাষ্ট্র, জাতিসংঘের আহ্বান, অনুরোধ যেখানে ব্যর্থ ঠিক তখনই এক ফুটবলই দেশকে করেছে একত্র, দেশে ফিরিয়ে এনেছিলো শান্তি। আফ্রিকার এই দেশটির গন্ডি পেরিয়ে দ্রগবা নাম কামিয়েছেন ইউরোপে, বিশেষ করে ইংলিশ ক্লাব চেলসির একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
দিদিয়ের দ্রগবা ১১ মার্চ ১৯৭৮ সালে জন্ম নেন আইভরিকোস্টের আবিদজানে। তব, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার মা -বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো ফ্রান্সে। যদি ও সমস্যার জন্য আবার ৩ বছর পর নিজ দেশেই আসতে হয়েছিলো এই ফুটবলারের এবং পরবর্তীতে আবার ও ফ্রান্সে আসেন দ্রগবা। শুরুর দিকে অনুশীলনে ও নিয়মিত হতে পারেননি।
যুব দলে তার অভিষেক ঘটে ২১ বছর বয়সে,
এরপর ৩৪ ম্যাচে ১৭ গোল করে শেষ সারির দল গুইনগাম্পকে ৭ম স্থানে এনে দেন দ্রগবা৷ তার পারফরম্যান্স এর উপর নজর দিলো ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট মার্সেই, যোগ দিলেন মার্সেই এ। এরপর সে মৌসুমে ২৪ গোল করে ডাক পান ইংলিশ জায়ান্ট চেলসিতে। চেলসিতে যোগ দিয়েই ৫০ বছর পর চেলসিকে লীগ শিরোপার স্বাদ দেন, এরপরের বছর ও প্রিমিয়ার লীগের স্বাদ এনে দেন দ্রগবা এবং তিনিই সর্বপ্রথম আফ্রিকান যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ১০০ গোল করেছিলো। ২০১২ সালে এফ এ কাপের ফাইনালে লিভারপুলের বিপক্ষে জয়সূচক গোল এবং চ্যাম্পিয়নস লীগে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ও জয়সূচক পেনাল্টিতে গোল করেন দ্রগবা। ক্লাব ফুটবলে ৪৯৭ ম্যাচে ২২০ গোল করেন এই ফুটবলার। ক্লাব ক্যারিয়ারে ২৫০ এর অধিক ম্যাচ খেলেছেন শুধু চেলসিতেই। পাঠক, তুলে ধরার চেষ্টা করবো দ্রগবার চেলসির ক্লাব ক্যারিয়ার-
চেলসিতে দ্রগবার ক্লাব ক্যারিয়ারঃ ২০০৪ সালের জুলাইয়ে ২৪ মিলিয়ন পাউন্ডে চেলসিতে যোগ দেন দ্রগবা। দ্রগবা নিজের চেলসির ক্যারিয়ারের ৩ নাম্বার ম্যাচে দেখা পান নিজের অভিষেক গোল। গোলটি করেছিলেন তিনি ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে৷ ২০০৪-০৫ সিজনে চেলসি ইংলিশ লীগ জিতে। সে সিননে চেলসির হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়াটার ফাইনাল ম্যাচে সে লিভারপুলের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে দলকে নিয়ে যান সেমিফাইনালের মঞ্চে৷ চেলসিতে নিজের প্রথম সিজনে ৪০ ম্যাচে ১৬ গোল করেছেন এই আফ্রিকান৷ড্রাগবা আর্সেনালের বিপক্ষে একটি কমিউনিটি শিল্ড জিতে দুটি গোল করে ২০০৫-০৬ মৌসুম শুরু করেছিলেন। চেলসি ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে জয়ের সময় প্রতারণার অভিযোগে তার খ্যাতি আরও মারাত্মক হয়েছিল। পরবর্তী সিজনে ও ব্লুজরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের ট্রফি জিতে পাশাপাশি সেই সিজনে ও দ্রগবা ১৬টি গোল করেন৷ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ১২টি, কমিউনিটি শিল্ডে কাপে দুটি, এফ এ কাপে ও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে ১ টি করে দুটো গোল করে মোট ১৬ গোল করেছিলেন তিনি।
২০০৬-০৭ সিজনে দ্রগবার ঝুলিতে ছিলো ব্যাক্তিগত অর্জন৷ আগের ১৫ নাম্বার জার্সি ছেড়ে নামেন ১১ নাম্বার জার্সি পরে মৌসুম জুড়ে করেছেন ৩৩ গোল৷ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগেই ২০ গোল করে গোল্ডেন বুট উইনার ছিলেন। ছয়টি গোল চ্যাম্পিয়নস লীগে, তিনটি এফ এ কাপ গোল, চারটি লীগ কাপ এ গোল করেন৷ ২০০৭ সালে তিনি আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব জিতেছিলেন।২০০৮ সালে জেনস লেহম্যানের পরে – ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে থাপ্পড় মারার জন্য ২০০৮ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের ১১৭ তম মিনিটে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দ্রগবাকে মাঠ থেকে বিদায় জানানো হয়েছিল, সহিংস আচরণের জন্য। চেলসি অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলে ড্র করার পরে পেনাল্টিতে ৬-৫ হেরে যায়। চেলসির সহকারী বস হেনক টেন কেট প্রকাশ করেছেন যে শুটআউটে সিদ্ধান্ত নেওয়া পঞ্চম স্পট-কিক নেওয়ার কারণেই ছিলেন দ্রোগবা। টিম অধিনায়ক জন টেরি তার জায়গা নিলেও পেনাল্টি নেওয়ার পরে পিছলে যাওয়ার পরে মিস করেন পেনাল্টি। ২০১০ সাল চেলসির জন্য ভালো সময় ইংলিশ লীগের পাশাপাশি ইংলিশ কাপের ট্রফি ও নিজেদের করে নেয় চেলসি৷ সে সিজনে দ্রগবা চেলসির ক্যারিয়ারে নিজের ১০০ তম গোলের দেখা পেয়েছিলো৷ সে সিজনে ওয়েন রুনির ২৬ গোলকে টপকে ২৯ লীগ করে গোল্ডেন বুট ও জিতেছিলো দিদিয়ের দ্রগবা। ২০১১-১২ সিজন চেলসির জন্য ছিলো সোনালি সময়।
২০১১-১২ সিজনে চেলসিকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ট্রফি উপহার দেয় দ্রগবা। সে বছর ১৫ ই এপ্রিল লন্ডনের আরেক ক্লাব, প্রতিপক্ষ টটেনহাম হটস্পারের বিপক্ষে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে দ্রগবা তার সপ্তম গোলটি করেছিলেন, প্রাক্তন সতীর্থ কার্লো কুডিসিনিকে বল ধরিয়ে দিয়ে চেলসি ৫-১ জেতাতে সাহায্য করেছিলেন এবং লিভারপুলের বিপক্ষে এফএ কাপ ফাইনালে জায়গা পেয়েছিলেন। তিন দিন পরে, তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গোল করেছিলেন যেহেতু চেলসি তার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালের লড়াইয়ের প্রথম লেগে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের বার্সেলোনাকে ১-০ গোলে হারিয়েছে। ৫ মে লিভারপুলের বিপক্ষে চেলসির ২-১ গোলে জয়লাভের জয়ে জয়ের শিকার হয়ে দ্রগবা চারটি আলাদা এফএ কাপ ফাইনালে গোল করার প্রথম খেলোয়াড় হয়েছিলেন। নতুন ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে আটটি করে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডও রয়েছে দ্রগবার।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ১৯ মে ২০১২, দ্রগবা ৮৮ তম মিনিটে অতিরিক্ত সময় এবং তারপরে পেনাল্টিতে নিয়ে গিয়ে ৮৮ তম মিনিটে জুয়ান মাতার কর্নার থেকে সমতা অর্জনকারীকে গোল করেছিলেন। তিনি ৪-৩ পেনাল্টি শ্যুটআউটে জয়ের পেনাল্টিও করেছিলেন যা চেলসিকে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে জয়ের দিকে নিয়ে যায়। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন মন্তব্য করেছিলেন: “যতদূর আমি উদ্বিগ্ন, তিনি [দ্রগবা] চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন।”] দ্রগবার নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টা চেলসির হয়ে নয় কাপের উপস্থিতিতে তার নবম গোলটি চিহ্নিত করেছে, চেলসির কিংবদন্তি জিয়ানফ্র্যাঙ্কো জোলার পরে বক্তব্য রেখেছিলেন বড় গেমগুলিতে দ্রোগবার দক্ষতা সম্পর্কে ম্যাচ করুন: “তাদের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি এটির উপরে একটি স্ট্যাম্প রেখেছেন।” নভেম্বর ২০১২ সালে চেলসি ম্যাগাজিন পরিচালিত ২০,০০০ ভক্তের জরিপে দ্রগবাকে চেলসির সর্বকালের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করা হয়েছিল।
শুধুই কি ক্লাব সাফল্য? না, ক্লাবের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়ে ও সাফল্য পেয়েছেন এই আফ্রিকান ফুটবলার। নিজ দেশ আইভরিকোস্টকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চে যেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো দ্রগবা। আইভরিকোষ্টকে আফ্রিকান কাপের ফাইনালে ও নিয়ে গিয়েছিলো এই ফুটবলার। হয়েছেন বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলারও।
জাতীয় দলের হয়ে ১০৫ ম্যাচে ৬৫ গোল করা এই স্ট্রাইকার শুধু একজন ফুটবলার নন, আইভরিকোষ্ট এর প্রতিটি মানুষের কাছে ভালোবাসার চাইতে ও যেনো অনেক বেশী। ভালোবাসার চাইতে বড় কিছু বলেই তো রাস্তার পোস্টার, কফি শপে, শপিং মলে, জুতা, ব্যাগে এই মানুষটির ছবি শোভা পেতো। শুধু গোটা জাতিকে এক করেছিলো ফুটবলীয় শক্তি দিয়ে, জাতিকে দেখিয়েছিলো নতুন পথ, জাতিকে দিয়েছিলো অক্সিজেন।
Leave a Reply