স্পোর্টস ডেস্কঃ বিশ্বকাপের ফাইনাল মঞ্চে স্ট্রাইকারের পজিশন থেকে বল পেয়ে নিখুঁত ভাবে বল জালে জড়িয়ে নিজের দেশকে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফির স্বাদ দেন তিনি৷ লেফট মিড পজিশনের এই খেলোয়াড় কখনো ঠান্ডা মাথায় সিম্পলি দুইজনকে ড্রিবলিং করে সামনে এগিয়ে যান, কখনো দেখা যায় টিম মেইটদের পাস দিতে, কখনো দেখা যায় তাকে এসিস্ট করতে। এল ক্লাসিকোর ম্যাচগুলোতে দেখা গিয়েছে তার পজিটিভ পারফরম্যান্স। একবার তো মড্রিচ আর এসেনসিও তার ড্রিবলিং দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। এল ক্লাসিকোর মঞ্চেই পুরো ডিফেন্স লাইন ব্রেক করে টিম মেইট জাভির উদ্দেশ্যে বল দিয়ে তাকে দিয়ে করান গোল৷ ক্যাম্প ন্যুতে সে রাতে তার চোখ ঝলঝল করে লাল হয়েছিলো, অশ্রুভেজা নয়নেতো কখনো সমর্থকরা তাকে দেখে নাই, আর দেখবেই বা কি করে? ক্যাম্প ন্যুতে সবাই চলে যাওয়ার পর সেদিন সে খালি পায়েই ক্যাম্প ন্যুর সবুজ গালিচায় হেঁটেছিলো, পায়ের স্পর্শ ফেলেছিলো ক্যাম্প ন্যুর সবুজ গালিচায়। চুপ করে বসে ছিলো ক্যাম্প ন্যুতে একা একা অশ্রুভেজা নয়নে৷ যেনো গানের লাইনের মতো, ” তুমি আমার নওতো সুখ,তুমি সুখের বেদনা”।
২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমিফাইনালের সেকেন্ড লেগ স্টামফোর্ড ব্রিজে ১-০ গোলে পিছিয়ে বার্সেলোনা৷ মনে হচ্ছিলো বিদায়ের ঘন্টা বাজবে কাতালান এই ক্লাবটির ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের আসর থেকে৷ কিন্তু না! দলের হয়ে ত্রাতা হয়ে আসলেন বার্সা একাডেমি থেকে উঠে আসা মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ম্যাচের ৯২ তম মিনিটে ডিবক্সের বাইরে লিওনেল মেসির বাড়ানো পাস থেকে বুলেট গতিতে শটে পিটার চেককে পরাস্ত করে তিনি বার্সেলোনাকে এনে দেন কাঙ্ক্ষিত অ্যাওয়ে গোল। ১-১ গোলে সমতায় ম্যাচ শেষ হলে ঐ অ্যাওয়ে গোল নির্ধারিত করে দেয় বার্সেলোনার ফাইনাল। তার গোলের সুবাদেই ইংলিশ দূর্গ জয় করে রোমের ফাইনালের মঞ্চে আরেক ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মুখোমুখি হয় বার্সেলোনা৷ সেই ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে এসিস্টের দেখা পেয়েছিলেন এই ইনিয়েস্তা। ম্যাচের আগে রেড ডেভিলদের কোচ স্যার এলেক্স ফার্গুসন বলেন, ” ইনিয়েস্তা সে অসাধারণ। সে দলগত খেলা খেলে, সে মিডফিল্ডে অনেক স্পেস নিয়ে খেলে৷ ফুটবলে তার সুন্দর মুভমেন্ট ও রয়েছে, সে বার্সার একজন গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার। “
২০১৯ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ের পরের বছরই ছিলো ২০১০ বিশ্বকাপ৷ ২০১০ বিশ্বকাপে সবাইকে চমক দিয়ে স্পেন জাতীয় দল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ অর্জন করে। সে দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন খেলোয়াড় এর মধ্যে ছিলেন তিনি। আফ্রিকার দেশের ফাইনালের মঞ্চে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেছিলেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। ধারাভাষ্যকারের কন্ঠে বেজে উঠলো
” Iniestaaaaa…..This is it! That’s the goal! Spain have surely won the world cup!”
ইনজুরিতে জর্জরিত হয়েও ২০১০ বিশ্বকাপে তিনি গিয়েছিলেন বীরের বেশে। ইকার ক্যাসিয়াস গোল ঠেকিয়ে আর আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা গোল করিয়ে স্পেনকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। তবে বীর যোদ্ধার গল্পগাঁথা যে আরো বাকি। নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৩ মিনিটে সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের পাস থেকে গোল করে এনে দিয়েছিলেন স্পেনের স্বপ্নের বিশ্বকাপ। হারানো আত্মবিশ্বাস খুঁজে, ইনজুরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইনিয়েস্তা বীর যোদ্ধার বেশে যদি না ফিরতেন, তাহলে কি বিশ্বকাপ জয়ের উপন্যাস লিখা যেতো? এ যেন এক রুপকথার জন্ম দিয়েছিলো আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা।
১৯৮৪ সালে ১১ মে স্পেনের ছোট্ট এক গ্রামে জন্ম নেয় এক নম্র, ভদ্র, লাজুক বালক। যার লাজুকতা এতই বেশি ছিলো যে কেউই হয়তো তাকে দেখে ভাবেনি তারা ফুটবলের ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়কে দেখছে। ১০ বছর বয়সে শুরু তার ফুটবলের হাতেখড়ি স্পেনের লোকাল ক্লাব আলবাসেতে খেলার মাধ্যমে। এরপর ২৪ টা বছর পার হয়ে গেছে। আজ ইনিয়েস্তা পা রাখলেন ৩৬ বছর বয়সে। মাঝে ইনিয়েস্তা রেখে গেছেন এমন এক সোনায় মোড়া ক্যারিয়ার যেটা গোল কিংবা এসিস্ট দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
জাতীয় দল এবং বার্সার হয়ে ইনিয়েস্তাঃ ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনা যুব দলের হয়ে খেলেছেন৷ ২০০২ সালে বার্সেলোনা মূল দলের অভিষেক হয় এই খেলোয়াড়ের। ২০০৪-০৫ সিজনে ৩৮ ম্যাচের মধ্যে ৩৭ ম্যাচেই খেলেছেন তিনি। ২০০৫-০৬ সিজনের শুরুতে জাভির ইঞ্জুরির কারণে সে সিজনে জাভির জায়গায় একাদশে খেলার সুযোগ পায়।তিনি ১১ টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলেছিলেন। বার্সেলোনা লিগ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিগুণ জয় লাভ করায় দলে ম্যানেজার ফ্র্যাঙ্ক রিজকার্ড দলে তাঁর অবদানের প্রশংসা করেছিলেন।
২০০৬–০৭ মৌসুমে ইনিয়েস্তার প্রোফাইল বাড়তে থাকে এবং তার দলের হয়ে যে কোনও পজিশনে খেলতে ইচ্ছুক বলে তিনি প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। প্রাক মৌসুমে, তিনি জার্মান দলের বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ৪-০ ব্যবধানে জয়ের পরে দলের অধিনায়ক হিসাবে জোয়ান গ্যাম্পার ট্রফি তুলেছিলেন। ইনিয়েস্তা প্রথমবারের মতো লেভস্কি সোফিয়ার বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দুটি ম্যাচে বার্সার লেফট ফরোয়ার্ড হিসাবে খেলেন, এবং দুবার জাল খুঁজে পেয়েছিলেন। একই প্রতিযোগিতার প্রথম নকআউট পর্বে তিনি লিভারপুলের বিপক্ষে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে খেলেছিলেন। ম্যানেজার রিজকার্ডের কাছে পিচ ঘুরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, ২০০৬-০৭ সিজন এখনও পর্যন্ত ইনিয়েস্তার সর্বোচ্চ স্কোর হিসাবে রয়ে গেছে। এরপর বার্সার হয়ে জয় করেছেন কত ট্রফিখানা।
২০১৭-১৮ মৌসুম ছিলো বার্সেলোনার হয়ে ইনিয়েস্তার শেষ স্প্যানিশ লিগ। নিজের শেষ লিগও তিনি রাঙিয়ে রাখলেন দারুনভাবে। স্প্যানিশ লা লিগাতে এবার বার্সেলোনার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো। পুরো মৌসুমে বার্সেলোনা ছিলো টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত। ৩৪ বছর বয়সেও আর্নেস্তো ভালভার্দের ভরসা ছিলো ইনিয়েস্তার উপরে। যে কারণে অধিকাংশ ম্যাচেই শুরু থেকে মাঠে ছিলেন তিনি। যদিও বয়সের কারণে এবং ডেনিস সুয়ারেজ, পাওলিনহো ও কৌতিনহোকে সুযোগ করে দিতে প্রায় ম্যাচে ৬০ মিনিট পর বার্সেলোনা কোচ তুলে নিতেন ইনিয়েস্তাকে।
এ মৌসুমে বিদায় না দিলে আসন্ন মৌসুমেও হয়ত বার্সেলোনা বিশ্বাস রাখতো ইনিয়েস্তার উপর। অন্যদিকে কোপা দের রে-তে সেভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিলো বার্সেলোনার হয়ে ইনিয়েস্তার শেষ ফাইনাল। এ ম্যাচের আগে তার সম্পর্কে হাজারো উড়ো খবর ভেসে বেড়ালেও বার্সেলোনা ছাড়ার পক্ষে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য তিনি তখনো দেননি। ওয়ান্দা মেট্রোপলিটনে সেই ম্যাচে বার্সেলোনা জিতেছিলো ৫-০ গোলে। ইনিয়েস্তা করেছিলেন ৪র্থ গোলটি। জয় নিশ্চিত চতুর্থ গোলের পর ইনিয়েস্তার উদযাপন, সাবস্টিটিউট হয়ে ম্যাচ ত্যাগের সময় তার মুখের অভিব্যক্তি ও ডাগআউটে অশ্রুজল চোখে বসে থাকা দেখে অনেকেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো বার্সেলোনায় আর তিনি থাকছেন না। কয়েকদিন পর আসলো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য, বার্সেলোনার হয়ে ৩২টি শিরোপা জেতা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা পাড়ি জমাচ্ছেন নতুন এক অচেনা গন্তব্যে।
২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত টানা ৬ বছর ছিলেন নিজের সেরা ফর্মে। ২০১১ সালে ব্যালন ডি অরের সেরা তিনে ছিলেন, বার্সেলোনার হয়ে ৭ বার লিগ শিরোপা জিতেছেন। ২০১৫ সালে ট্রেবল জেতা দলের মধ্যমাঠের প্রাণ ছিলেন তিনি। বার্সেলোনায় থাকাকালে যেমন তাকে ছাড়া মধ্যমাঠ ভাবা যেতো না, তেমনই অবসর না নেওয়া পর্যন্ত ইনিয়েস্তার পরিবর্তে স্পেন দলে অন্য কেউ সুযোগ পায়নি। একজন মিডফিল্ডার হিসেবে সম্ভাব্য সকল শিরোপাও জিতেছেন তিনি। ২০১৮ সালে শৈশবের ক্লাবের মায়া কাটিয়ে, বর্তমানে তিনি খেলছেন জাপানী ক্লাব ভিসেল কোবেতে।
ইনিয়েস্তার বিদায়ী রাতে ন্যু-ক্যাম্পের কৃত্রিম আলো নিভে গেছে সেই সাড়ে বারোটার সময় । রাত দেড়টার দিকে অন্ধকার একলা মাঠে হঠাৎ-ই দেখা গেল তাকে। ঘুরে ফিরে দেখলেন পুরো মাঠ একদম শেষে ঠিক মাঝখানটাতে বসে সেলফি তুললেন। একটু কি যেন ভাবলেন, একটু আবার থমকে গেলেন। কাতালান এই স্টেডিয়ামের প্রত্যেকটা গাঁথুনিকে আলাদা করে চেনেন তিনি। লাখ-খানেক দর্শকের সামনে এই মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অজস্রবার, দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন কিছুক্ষণ আগেও। তাঁর স্মৃতির আকাশটা জুড়ে বোধহয় জমাট বাঁধছিল বজ্রপাতের মতো।
ফিফা বিশ্বকাপ : ১টি ( ২০১০ সালে)
ইউরো চ্যাম্পিয়ন : ২০০৮ এবং ২০১২ সালে
ইউরো চ্যাম্পিয়ন : অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯
লা লীগা ট্রফির সংখ্যা : নয়টি
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ : চারটি ট্রফি
কোপা দেল রে : ছয়টি ট্রফি
স্প্যানিশ সুপার কোপা : তিনটি
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ : তিনটি
Leave a Reply