ডোনাল্ড ট্রাম্প আমার কাছে এক আতংকের নাম!ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে যাক, এই জন্য এমনকি প্রতিদিন নামজ পড়ে প্রার্থনা করেছি।এখন আপনারা হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন- আদার বেপারী হয়ে জাহাজের খবর রেখে আমার ফায়দা কি? কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হলো, এতে আমার মতো অতি নগণ্য মানুষের কি যায়-আসে?
বিষয়টা আসলে অনেকটা এই রকম- আমি রাজনীতি পছন্দ করি না। “আই হেইট পলিটিক্স!” আবার এই আমি’ই দেশে চাকরি’র অভাব বলে মুখে ফেনা তুলছি। শিক্ষার অবস্থা খারাপ বলে সমালোচনা করছি। এটা নেই- ওটা নেই বলে বেড়াচ্ছি। আবার এক’ই সঙ্গে বলছি- “আই হেইট পলিটিক্স!”
ব্যাপারটা আমি আমার লেখার পরের অংশে ব্যাখ্যা করবো।
হিলারী ক্লিন্টনের বিপক্ষে জিতে যাবার পর ট্রাম্প প্রথম কথা কি বলেছিল জানেন?
– হিলারী হেরে গিয়েছে। সে একজন লুজার। আমার ডিকশনারি’তে লুজারদের জন্য কোন স্থান নেই!
হ্যাঁ, ঠিক’ই পড়ছেন। আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ঠিক এই কথা’টাই বলেছিলেন।
ট্রাম্প আরো কি কি বলেছে কিংবা বিশ্বাস করে, তার ছোটখাটো তালিকা বরং দিয়ে নেই।
– নারী’রা দুর্বল, সুতরাং তারা লুজার।
-এলজিবিটি কমিউনিটি’র মানুষ’রা সংখ্যায় কম। সুতরাং তারা দুর্বল। তারাও লুজার। এই প্রেসিডেন্ট এমনকি এদের সেনাবাহিনী’তে কাজ করার অধিকার রহিত করতে চেয়েছে এবং করেছে!
-ইমিগ্রেণ্ট’রা বেশিরভাগ’ই দেখতে কালো কিংবা উদ্ভট। অনেকটা মনস্টারের মতো। সে এমনকি কামালা হ্যারিস’কে এইতো সেদিনও মনস্টার বলেছে! সুতরাং এরাও সবাই লুজার।
-মুসলিম’রা সন্ত্রাসী। তাই এদেরকে আমেরিকায় ঢুকতে দেয়া যাবে না। তাই এরাও লুজার!
-যারা দরিদ্র, গরীব তারা নোংরা, বিশ্রী! সুতরাং এরাও লুজার। আপনাদের জানিয়ে রাখি আমেরিকায় পুরতো-রিকো নামে একটা রাজ্য আছে। এটি আসলে অনেকটা ওরা দখল করে রেখেছে। তো, এই রাজ্যটা অনেক দরিদ্র। এই প্রেসিডেন্ট এদের নিয়ে কি বলেছে জানেন? “পুরতো-রিকো একটা নোংরা রাজ্য। এরা সবাই কালো কালো মানুষ আর দরিদ্র! আমি এই রাজ্য বিক্রি করে দিতে চাই।” সে এমনকি ডেনমার্কের কাছে পুরতো-রিকো’কে বিক্রি করে দিতে চেয়েছে। বিনিময়ে ডেনমার্কের গ্রিনল্যান্ড কিনে নেবে! এই নিয়ে এমনকি আলোচনাও চলছিল! কে জানে, হয়তো আরেকবার নির্বাচিত হলে নোংরা পুরতো-রিকো’কে বিক্রিও করে দিত!
– এই প্রেসিডেন্টের কাছে যারা দুর্বল, তারা লুজার! কোভিডে আক্রান্ত হয়ে আমেরিকায় যারা মারা গিয়েছে; তার কাছে ওরা হচ্ছে দুর্বল! তাই ওরা সবাই লুজার! সে নিজেও আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তার কিছু হয়নি! তাই সে হচ্ছে উইনার!
আরও কি বলেছে জানেন?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার হয়ে যে সৈন্যরা যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গিয়েছে; তাদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সে বলেছে
– এদেরকে শ্রদ্ধা করতে হবে কেন? এরা তো যুদ্ধে গিয়ে বেঁচে ফিরেনি। মারা গিয়েছে। এরা তো লুজার! এদেরকে শ্রদ্ধা করার কি আছে!
এই হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বলা কিছু কথা কিংবা সে যা বিশ্বাস করতো তার অল্প কিছু তুলে ধরলাম।
তার বানী খুব পরিষ্কার।
যারা হোয়াইট, তারা সুন্দর। তারা পরিষ্কার। তারা সংখ্যায় বেশি। সুতরাং হোয়াইট মানেই সেরা কিংবা সুপ্রীম!
এইসব কালো, অভিবাসী, এলজিবিট কিংবা দরিদ্র মানুষ; এরা সবাই হয় নোংরা, নয়ত লুজার!
গরীব-দুঃখী, হেরে যাওয়া কিংবা পরাজিত মানুষের কোন স্থান তার ডিকশনারি’তে নেই!
তো, তার এই দর্শনের প্রভাব কিভাবে পৃথিবীতে পড়েছে জানেন?
আজ আমার মনে পড়ছে সেই ছাত্রটার কথা। যে বাংলাদেশ থেকেই আমার এখানে এসছে। বাসে করে অফিসে যাচ্ছিলো। এক হোয়াইট লোক তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছে- এই দেশে ইমিগ্রেণ্টদের স্থান হবে না।
মনে পড়ছে নিউজিল্যান্ডের সেই ঘটনা। মসজিদে ঢুকে যেই হোয়াইট সন্ত্রাসী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেক গুলো মানুষকে শুধু হত্যা’ই করেনি; সেটা ফেসবুকে লাইভও করেছে। সে কিন্তু এরপর বলেছে- আমি ট্রাম্পের সাপোর্টার!
মনে পড়ছে আমার সেই সহকর্মীর কথা। যে আমাকে বলেছে- তোমার কি মনে হয় না তুমি ভাগ্যবান? অভিবাসী হয়েও কিংবা “এক্স”, ওয়াই”, “জেড” হয়েও তুমি ভালো একটা চাকির করছ! সেও কিন্তু এই ট্রাম্পের সাপোর্টার’ই ছিল।
এইবার বুঝতে পারছেন তো, এক ট্রাম্প কি করে পুরো পৃথিবীতে তার দর্শন ছড়িয়ে দিচ্ছিল? যার প্রভাব এমনকি আমার মতো অতি নগণ্য মানুষের মাঝেও এসে পড়েছে!
ট্রাম্প যদি এইবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতো; তাহলে কি হতো জানেন?
পৃথিবী জুড়ে নানান দেশের রাজনীতিবিদরা বুঝে নিত এভাবেই রাজনীতি করতে হবে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে। তখন নানান দেশ থেকে অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেয়া হতো। সংখ্যায় কম কিংবা সংখ্যালঘু এমন সবাই তখন সব সময় আতংকে থাকতো। দুর্বল, দরিদ্র মানুষদের জন্য পৃথিবীটা তখন আরও কঠিন হয়ে যেত।
সোনার চামুচ মুখে দিয়ে জন্ম নেয়া বিলিয়নিয়ার এই ট্রাম্প কি করে বুঝবে দরিদ্র মানুষের কষ্ট? সে কি করে বুঝবে দুর্বল মানুষের কষ্ট?
সে তো মনে করছে, কোভিড আক্রান্ত হয়ে সে নিজে সুস্থ হয়েছে। তাই সে উইনার। অন্যরা যারা মারা গিয়েছে, তারা লুজার! অথচ সে যেই চিকিৎসা পেয়েছে; সেটা খোদ আমেরিকার ৯৮ ভাগ মানুষ পায়নি। এই সাধারণ বিষয়টা বুজার মতো সামর্থ্যও এই মানুষটার নেই।
বিজয়ী হবার পর গতকাল বাইডেন বলেছে
– আমি প্রতিটা মানুষের জন্য গর্বিত। আপনি ডেমোক্রেট হন কিংবা রিপাবলিকান। প্রগতিশীল হন কিংবা রক্ষণশীল। ইয়ং কিংবা ওল্ড। গ্রামের কিংবা শহরের। গে, স্ট্রেইট কিংবা ট্রান্স জেন্ডার। হোয়াইট, ল্যাটিনো, এশিয়ান কিংবা নেটিভ আমেরিকান; সেটা কোন ব্যাপার নয়। এই বিজয় সবার এবং আমি প্রতিটা আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট। যারা আমাকে ভোট দেয়নি, আমি তাদের জন্যও ঠিক এক’ই ভাবে কাজ করবো।
বাইডেনের অতীত ইতিহাস যে খুব ভালো এমনও কিন্তু নয়। কিন্ত মন্দের ভালো বলেও তো একটা কথা আছে। ট্রাম্প পৃথিবী ব্যাপী যে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছিল; অন্তত সেটা থেকে পৃথিবী কিছুটা হলেও রেহাই পাবে।
গত পরশু দিন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেস কনফারেন্সে এসে কিছু কথা বলেছে। তার কথা গুলো মনে হচ্ছিলো ভেঙে ভেঙে আসছে! মনে হচ্ছিলো আঁটকে যাচ্ছে বার বার! দেখে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিলো মানুষটা ভেঙে পড়েছে। একজন পরাজিত মানুষের চেহারা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমার কিন্তু তার এই পরাজিত চেহারা দেখে খারাপ লেগেছে। মানুষটার জন্য আমার মায়া হচ্ছিলো। একটু হলেও তার কষ্ট বুঝতে পারছিলাম। জীবনে চলার পথে অনেক বার পরাজিত হয়ে, অনেক যুদ্ধ করে’ই না তবে এই অবস্থায় এসছি। তাই দুর্বল মানুষ, দুখী মানুষ দেখলে’ই মনটা কেমন করে উঠে।
এটা’ই হয়ত প্রগতিশীল এবং রক্ষণশীলের মাঝে পার্থক্য। যে ট্রাম্প জয়ী হয়ে পরাজিত প্রার্থী’কে লুজার বলেছে। যেই ট্রাম্প কালোদের বিশ্রী আর দরিদ্রদের নোংরা কিংবা লুজার বলে মনে করে এসছে; সেই ট্রাম্পের পরাজিত মুখ দেখে আমার মন কেঁদে উঠেছে।লেখাটি আমিনুল ইসলাম স্যার এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।
Leave a Reply