পৃথিবীতে আজকে যে সূর্যের আলো এসেছে তা ১০ লক্ষ বছর আগের

যেকোনো জীবনের জন্য আলো অপরিহার্য একটি উপাদান।আমাদের চারপাশে যত রকমের বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই তা মূলত এই আলোর কারনেই।আর আমাদের এই আলোর উৎস হল সূর্য।আপনি হয়ত শীতের সকালে সূর্যের আলোতে বসে সূর্য মামাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।কিন্তু আপনি জানেন কি যে আলো/তাপের জন্য আপনি সূর্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন তা আজকে থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে সূর্যের কেন্দ্রে তৈরি হয়েছিল এবং আপনি ১০ লক্ষ বছর আগের সূর্যের তাপ আজকে ১০ লক্ষ বছর পর উপভোগ করছেন।কি অবাক বিষয় তাই না?আসলেই বিষয়টা আমাকেও প্রথমে অবাক করেছিল পরে বিভিন্ন সোর্স থেকে একটু পড়াশোনা করার পর বিস্ময় দূর হয়েছে।আমরা আজকের এই আর্টিকেলে জানবো কিভাবে পৃথিবীতে আজকে যে সূর্যের আলো এসেছে তা ১০ লক্ষ বছর আগের?এই আর্টিকেল সম্পূর্ণ পড়ার পর আপনারও বিস্ময় দূর হয়ে যাবে কথা দিচ্ছি।তাহলে চলুন শুরু করি-

আপনি নিশ্চয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার নাম অনেকবার শুনে থাকবেন।সূর্যের কেন্দ্রে অনবরত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে চলেছে এবং এই বিক্রিয়ার ফলে সূর্য ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রা উৎপন্ন করে এবং সাথে উৎপন্ন করে বিপুর পরিমান শক্তি যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা।আমাদের অথবা যেকোন জীবের বেঁচে থাকার জন্য যেমন হার্ট থাকা আবশ্যক তেমনি সূর্যের বেঁচে থাকার জন্য নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া চালু থাকা জরুরী।

সূর্যের গঠন বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগে হয়ে থাকেঃ ১) কেন্দ্রীয় অঞ্চল ২) বিকিরণ অঞ্চল ৩) পরিচলন অঞ্চল এই রকম আরও কিছু অঞ্চলে সূর্যের গঠন।এর মধ্য কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সূর্য তাঁর জ্বালানি পক্রিয়া সম্পূর্ণ করে থাকে এবং বাকী অঞ্চল গুলো সূর্যের উৎপন্ন করা ১৫ মিলিয়ন কেলভিন তাপমাত্রা সূর্যের বাহিরে ছড়িয়ে দেয়।

সূর্য তার কেন্দ্রে প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন শক্তি উৎপন্ন করে থাকে।এই শক্তি উতপাদন করার পক্রিয়া বিগত কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে অনবরত চলছে।সূর্য প্রতি সেকেন্ডে  ৫৬০ মিলিয়ন টন হিলিয়াম উৎপন্ন করে এবং এতে সূর্যের ৫৬৪ মিলিয়ন টন হাইড্রোজেন এর প্রয়োজন পরে।এবং সূর্য বাকী চার মিলিয়ন হাইড্রোজেন থেকে অন্যান্য শক্তি উৎপাদন করে।সূর্যের কেন্দে তৈরি হওয়া এই শক্তি ফোটন হিসাবে সূর্যের পৃষ্ঠ থেকে বাহিরের দিকে ছড়িয়ে পরে।

সূর্যের কেন্দ্রের ঘনত্ব পানির ঘনত্বর চাইতে ১৫ গুন বেশী।অন্যদিকে বিষুবীয় অঞ্চল বরাবর সূর্যের মোট ব্যাসার্ধ ৬,৯৫,৭০০ কিলোমিটার যা পৃথিবীর মোট ব্যাসার্ধের প্রায় ১০৯ গুন বেশী।সূর্যের কেন্দ্রে যে তাপ এবং শক্তি উৎপন্ন হয় সেই তাপ এবং শক্তিকে এই বিশাল এলাকা পাড়ি দিয়ে আসতে হয়।যদিও সূর্যের কেন্দ্র অঞ্চল এর চাইতে বাহিরের অঞ্চলের ঘনত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে।তারপরও এই বিশাল এলাকা পাড়ি দিতে সূর্যের তাপ এবং শক্তির অনেক সময় লাগে।আপনি জানলে অবাক হয়ে যাবেন যে,এই অঞ্চল পাড়ি দিতে একটি ফোটন কনার ১,৭১,০০০ বছর থেকে ১০ লক্ষ বছর সময় লাগে এবং একই কনার সূর্য পৃষ্ঠ থেকে আমাদের এই পৃথিবীতে সময় লাগে মাত্র সোয়া আট মিনিট।

এখন আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি এই মুহূর্তে পৃথিবীতে বসে যে সূর্যের তাপ উপভোগ করছেন তা আজকে থেকে কত বছর আগে সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন হয়েছিল?আর একারনেই বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যদি আমরা আমাদের মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থাকি তাহলে আমারা যা কিছু দেখতে পারব তা শুধুই এই মহাবিশ্বের অতিত এবং বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে সেইটা হয়ত আমাদের ভবিষ্যৎ কোন প্রজন্ম দেখবে। কিভাবে এই তড়িৎচুম্বুক তরঙ্গ এই বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে সৌর জগতে ছড়িয়ে পড়ছে তা আজকে আমরা এই আর্টিকেলে বিস্তারিত জানবো।

যে প্লাজমা গুলো সূর্যের কেন্দ্রকে ঘিরে রাখে তাঁদের ঘনত্ব অনেক বেশী।আর এই কারনেই ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হওয়া গামা রশ্মি যখন খুব কম দূরত্ব পাড়ি দেয় তখন ইলেকট্রন দ্বারা শোষিত হয়।এরপর এই ইলেকট্রন গুলো শোষিত হওয়া গামা রশ্মিকে পুনরায় সব দিকে নির্গমন করে।যখন এই শোষণ আর নির্গমন চলে তখন কেন্দ্রে উৎপন্ন হওয়া কিছু পরিমান শক্তি হারিয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়।এবং নির্গমন এর পরে এই গামা রশ্মি সূর্যের বিকিরন অঞ্চলে প্রবেশ করে।

সূর্যের বিকিরন অঞ্চল সূর্যের কেন্দ্র অঞ্চলের আবরণ হিসাবে কাজ করে।আর এই আবরনের কারনে সূর্যের কেন্দ্রে তৈরি হওয়া ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রা কে ধরে রেখে ফিউশন বিক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়।এবং সূর্যের কেন্দ্র অঞ্চল থেকে এই অঞ্চল পাড়ি দিতে একটি ফোটন কনাকে অসংখ্য বার ইলেকট্রন দ্বারা শোষিত এবং নির্গমন হতে হয়,আর এই কারনেই ফোটন কনা গুলোর গতি কমে যায় এবং সাথে কিছুটা শক্তিও কমে যায়,ফলে গামা রশ্মি এক্স-রে রশ্মিতে পরিনিত হয়।

সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন হওয়া ফোটন কনা সূর্যের বিকিরন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে তাপীয় পরিবহন পক্রিয়ায় পরিবাহিত হয়।বিকিরণ অঞ্চলের ঘনত্ব সূর্যের কেন্দ্র অঞ্চলের থেকে কিছুটা কম কিন্তু বিকিরণ অঞ্চলের পরবর্তী অঞ্চলের চাইতে বেশী হয়ে থাকে।সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন এক্স-রে বাবল কম তাপমাত্রা, ঘনত্ব, চাপের পথ অনুসরণ করে সূর্য পৃষ্ঠের দিকে গমন করে।এবং সূর্যের বিকিরণ অঞ্চল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, অসম্পৃক্ত ইলেকট্রন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে।সূর্যের বিকিরণ অঞ্চলের গভীর এলাকাতে এক্সরে বিভিন্ন কনার সাথে সংঘর্ষ ঘটে।আর এই সংঘর্ষের কারনে এক্সরে রশ্মি বার বার দিক পরিবর্তন করে ফেলে।এই সংঘর্ষের সময় দুটি ধাক্কার ফলে এক্সরে কনা/রশ্মি মাত্র কয়েক মিলিমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে।

এভাবে একের পর এক ধাক্কা খেয়ে এক্সরে রশ্মি সূর্যের বিকিরণ এবং অন্যান্য অঞ্চল ভেদ করে সূর্যের পৃষ্ঠের দিকে গমন করতে থাকে।এই পথ পাড়ি দিতে একটি ফোটন কনার ১৭১,০০০ বছর থেকে ১ মিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময় লাগে।ধাক্কার ফলে এক্সরের শক্তি প্লাজমা দ্বারা শোষিত হয়ে শক্তি কমে গেলেও তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়।ধীরে ধীরে এই এক্সরের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বাড়তেই থাকে এবং এক সময় এক্সরে আলোতে পরিনিত হয়।আলোতে পরিনিত হবার সাথে সাথে কেন্দ্রে উৎপন্ন হওয়া ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রা থেকে ১.৫ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রায় পরিনিত হয়।

সূর্যের বিকিরণ অঞ্চলকে যে বেষ্টনী ঘিরে আছে সেই অঞ্চলের ব্যাসার্ধ সূর্যের ৩০% হয়ে থাকে।এবং এই অঞ্চলই সূর্যের ভিতরের সর্বশেষ স্তর।এবং সূর্যের এই অঞ্চলের তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব সূর্যের বিকিরণ অঞ্চল থেকে কম হয়ে থাকে।সূর্যের এই অঞ্চলের নিচের অংশ (যে অংশটি বিকিরণ এলাকার নিকটবর্তী) গ্যাসীয় অনুর সাহায্যে  বিকিরণ অঞ্চল হতে বিকিরিত তাপ গ্রহন করে।যেহেতু গ্যাসীয় অনুসমুহের মাধ্যমে তাপ গ্রহন করে ফলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।এই সময় এই গ্যাসীয় অনুসমুহ বেলুনের মত ফুলে যায় ফলে এদের ঘনত্ব কমে যায়।ঘনত্ব কমে যাবার কারনে এরা উপরের দিকে,যেদিকে তাপমাত্রা কম সেদিকে চলে আসতে শুরু করে।

যখন এই গ্যাসীয় অণুসমূহ পরিচলন অঞ্চলের বাহিরে চলে আসে তখন তাপ বিকিরণ করে ঠাণ্ডা হয়ে যায়।তাপ বিকিরণ করে ঠাণ্ডা হবার ফলে এদের ঘনত্ব আবার বেড়ে যায় ফলে এরা আবার পরিচলন অঞ্চলের নিচে চলে আসে এবং আবার আগের পক্রিয়া অনুসরন করে।

এই তাপ পরিবহন পক্রিয়াটা অনেকটা পানির স্ফুটন এর মত যেখানে বাবল তৈরি হয়।বাবল তৈরির এই পক্রিয়াকে গ্রানুলেশন পক্রিয়া বলা হয়।এই সময় তাপ সঞ্চালন পক্রিয়া এত দ্রুত হয় যে,কোন ফোটন কে সূর্যের এই অঞ্চল পাড়ি দিতে এক সপ্তাহ থেকে তিন মাসের মত সময় লাগে।

গামা রশ্মির হল তড়িচ্চুম্বক বর্ণালীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গ।আর এই ক্ষুদ্রতার কারনেই গামা রশ্মি অনেক শক্তিশালী হয়ে থাকে।এবং সূর্যের কেন্দ্র থেকে এই গামা রশ্মি উৎপন্ন হয়ে সূর্যের বিভিন্ন অঞ্চল পাড়ি দিয়ে আলোতে পরিনত হয়।আপনি আমি যখন সূর্যের দিকে তাকাই তখন আমরা সূর্যের আলোক মন্ডল নামক যে অঞ্চলটি আছে সেইটা দেখতে পাই কারন তা গামা রশ্মি থেকে তৈরি হওয়া আলো প্রদর্শন করে।গামা রশ্মি সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন হয়ে এই স্তরে আসতে আসতে বিভিন্ন কনার সাথে ধাক্কা খেয়ে অথবা ইলেকট্রন দ্বারা শোষিত হয়ে নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং শক্তি হারানোর ফলে এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বড় হতে শুরু করে।আর এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেড়ে যাবার কারনেই সূর্য থেকে দৃশ্যমান আলো পাওয়া যায়।

তথ্য সুত্রঃ

http://www.astronoo.com

http://sciexplorer.blogspot.com

http://solar.physics.montana.edu/ypop/Spotlight/SunInfo/Radzone.html

https://www.universetoday.com/40631/parts-of-the-sun

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Trying to access array offset on null in /home/bcsaid/instabangla.com/wp-content/themes/disto/single.php on line 260