গুমোট বাঁধা নিস্তব্ধতা। ঘন গাছপালা। ঠিকমত পৌঁছাতে পারছে না সূর্যের আলোও। আবছা আলোতে নেই কোন জনমানব। গা ছমছমে ভাব। গভীরতা ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। তীব্র হচ্ছে লাশের গন্ধ। হঠাৎই সামনে পড়ল ঝুলন্ত একটি মৃতদেহ। মনে হচ্ছে এটা কোন হরর মুভি বা ভৌতিক উপন্যাসে ঘটে যাওয়া পরিচিত কোন দৃশ্য। কিন্তু শুধু হরর মুভি বা ভৌতিক উপন্যাস নয় বরং বাস্তবেই আপনি সম্মুখীন হতে পারেন এমন একটি দৃশ্যের।যদি এডভেঞ্চার ভালোবেসে থাকেন আর হতে চান এমনই গা শিউরে উঠা এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী তাহলে অওকিগাহারা হচ্ছে আপনার জন্য সঠিক জায়গা। অওকিগাহারা জাপানের একটি রহস্যময় বন। এ বনে যারা আসেন তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিই ভিন্ন।
পর্যটক বা ভ্রমণকারী নয়, বরং আত্মহত্যাকারী হতেই এ বনের পথে পা বাড়ান অসংখ্য মানুষ। আর তাই সুইসাইড ফরেস্ট বা আত্মহত্যার বন বলে এর বিশেষ কুখ্যাতি রয়েছে। অওকিগাহারা বন সম্পর্কে জাপানিদের মধ্যে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তারা বিশ্বাস করেন, এ বনের মধ্যে কেউ গেলে আর ফিরে আসে না। এধরণের কিছু ভয়ংকর তথ্যই অওকিগাহারাকে করে তুলেছে পৃথিবীর রহস্যময় স্থানগুলোর একটি।
অওকিগাহারা, জাপানের ফুজি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ৩৫ বর্গ কিলোমিটারের একটি জঙ্গল। এটি সি অব ট্রিজ অথবা গাছের সমুদ্র নামেও পরিচিত। কিছু অদ্ভুত পাথর এবং কোন প্রাণের অস্তিত্ব না থাকাতে সব সময় সুনসান নীরব এ বনটি পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
জাপানি পুরান মতে, এ বনে প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায় এবং এটি আত্মহত্যা করার জায়গা হিসেবে বিবেচিত। এই বন থেকে প্রতি বছর একশত এর বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।বনের মেঝে প্রাথমিক আগ্নেয়শিলা দ্বারা গঠিত। হস্তনির্মিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যেমন- শাবল, খন্তি ইত্যাদি দিয়ে বনের মেঝেতে গর্ত করা খুবই কঠিন। এছাড়া বনের ভেতর স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা নির্মিত কিছু মেঠো পথ আছে যেগুলোর মাধ্যমে আধা-নিয়মিতভাবে মৃতদেহ সংগ্রহ করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটক ও অন্যন্য ভ্রমণকারীরা তাদের যাওয়ার পথে প্লাস্টিকের এক ধরনের টেপ ব্যবহার করে তাদের চিহ্ন রেখে যায় যাতে তারা পরবর্তীতে পথ ভুলে না যায়।সরকারি লোকজন টেপের এই চিহ্ন মাঝে মাঝেই অপসারণ করে কিন্তু পর্যটকরা আবার লাগান। মূলত বনের প্রথম এক কিলোমিটারের মধ্যেই টেপের চিহ্ন বেশি দেখা যায়। তারপর ফুজি পর্বতমালার দিকে যতই গভীরে যাওয়া হয় বনের অবস্থা ততই আদিমযুগীয় মনে হয় ও মানুষের দেখা পাওয়া যায়না।
বনটি জাপানিদের কাছে আত্মহত্যার সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা এবং সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয় । আত্মহত্যার জন্য আমেরিকার সান ফ্রান্সিকোর গোল্ডেন ব্রিজ এর পর এর অবস্থান।হিসাবমতে প্রতিবছর এখানে গড়ে ১০০ জন মানুষ আত্মহত্যা করে।১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫শ’র মতো জাপানি এখানে আত্মহত্যা করেছেন। কেবল ২০০২ সালেই ৭৮টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় এখান থেকে যা ১৯৯৮ সালের উদ্ধার করা ৭৪ জন এর বেশি।২০০৩ সালের দিকে আত্মহত্যার হার ১০০ এর বেশি হয়ে যায় এবং তার পর থেকে জাপানি সরকার আত্মহত্যার হার প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
২০০৪ সালে ১০৮ জন লোক এখানে আত্মহত্যা করে, ২০১০ সালে ২৪৭ জন লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে যার মধ্যে ৫৪ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়।মার্চের সময় আত্মহত্যার হার বেরে যায়।২০১১ সালের দিকে যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের অধিকাংশ ফাঁসি অথবা বেশি পরিমাণে মাদক নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।১৯৭০ সালে পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক ও সাংবাদিকদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়েছিল যাদের কাজ ছিল মৃতদেহগুলো খুঁজে বের করা এবং লোকজনকে আত্মহত্যায় অনুৎসাহিত করা।১৯৬০ সালে সাইকো মাটসুমোটো নামক এক জাপানি লেখকের টাওয়ার অফ ওয়েবস নামে একটি উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই এখানে এসে আত্মাহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। এই উপন্যাসের দুটি চরিত্র এই বনে এসে আত্মহত্যা করেছিল। এর পর থেকে জাপানিরা এই বনে এসে এই আশায় আত্মাহুতি দেয় যে তাদের সন্তানেরা পরবর্তীতে ভালোভাবে চলতে পারবে!
কিছু সেচ্ছাসেবক দল এই এলাকায় সতর্ক প্রহরার ব্যবস্থা করে। বার্ষিক এই প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল আত্মহত্যাকারীদের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করা। পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকরা মৃতদেহ উদ্ধার করে যথাযথ সমাধির ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে জাপান সরকার উদ্ধারকৃত মৃতদেহের সংখ্যা প্রকাশ করতে নিষেধ করে। তবে প্রতি বছর ৭০ থেকে ১০০ টির মতো মৃতদেহ পাওয়া যেত। এ বনে ভ্রমণের অনুমতি থাকলেও যারা তাবু নিয়ে আসেন তাদের উপর রাখা হয় বিশেষ নজর। কেননা যারা কয়েকদিনের ক্যাম্পিং এ আসেন তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা নিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত থাকেন। ভাগ্যের সাথে শেষ বোঝাপড়া করে নিতেই তাবু খাটেন এই বনে। সুইসাইড প্রিভেনশন পেট্রলের স্বেচ্ছাসেবকরা এধরণের ক্যাম্পারদের ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন, অনুনয় বিনয় করে বন ছাড়তে বাধ্য করেন। .
স্বেচ্ছাসেবকরা মৃতদেহ উদ্ধারের সময় প্লাস্টিকের ফিতা বা টেপ দিয়ে রাস্তা মার্ক করে রাখেন। যাওয়ার সময় গাছে গাছে টেপ বেঁধে ভেতরে প্রবেশ করেন যেন আসার সময় রাস্তা চিনে বেরিয়ে আসতে পারেন। অন্যথায় যে কেউ পথ গুলিয়ে যাবেন এবং চিরতরে আটকা পরে যেতে পারেন বিভ্রান্তিকর এই অওকিগাহারায়।
অওকিগাহারার মাটিতে ম্যাগনেটিক আয়রনের পরিমাণ এতই বেশি যে সেলফোন সার্ভিস মোটেও কাজ করে না। জিপিএস সিস্টেম তো দূরের কথা এমনকি কম্পাসও এখানে অচল। এজন্যই টেপ বা প্লাস্টিকের ফিতা ব্যবহার করা ছাড়া অন্যকোনো উপায় নেই।
স্থানীয়রা মনে করেন এই বনটি তার মারাত্মক সম্মোহন ক্ষমতার জন্যই বিখ্যাত। এখনও পর্যটকরা পাশের মাউন্ট ফুজির সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারেন। পরিদর্শন করতে পারেন অসাদৃশ্যপূর্ণ লাভা, তিনশ বছরের পুরাতন গাছ ও মনোমুগ্ধকর নারুসাওয়া আইজ কেইভ।
অতিপ্রাকৃত এই বনটির অবস্থান জাপানের ফুজি পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিমে। গাছপালার প্রাচুর্যের জন্য কেউ বলে ‘ সি অফ ট্রিজ’ বা ‘বৃক্ষ-সাগর’। তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ বা ‘আত্মহত্যার বন’ নামে। পৃথিবীর সবচাইতে আত্মহত্যা-প্রবণ স্থানগুলোর ভেতরে এর অবস্থান দ্বিতীয়।
Leave a Reply