মহাবিশ্বের অন্য কোথাও কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান স্বত্বা আছে?থাকলে তারা কোথায় আছে?তাদের সাথে কি আমাদের দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
রেডিও টেলিস্কোপ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান এর প্রভূত উন্নতির সাথে সাথে মানুষের মনেও দানা বাধে এমন সব প্রশ্নের। বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষ আরো জোরালোভাবে এইসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে নেমে পরে। যতক্ষণ না আমরা প্রকৃতপক্ষে একটি এলিয়েন সভ্যতা আবিষ্কার করি, ততক্ষণ আমরা সবচেয়ে ভাল যা করতে পারি তা হলো তাদের অস্তিত্বের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনুমান করা। সেখানেই বিখ্যাত ড্রেক সমীকরণ (Drake Equation) – জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ ফ্রাঙ্ক ড্রেকের নামানুসারে – নাম আসে। 1960 এর দশকে বিকাশিত এই সমীকরণটি বিভিন্ন কারণের ভিত্তিতে সম্ভাব্য সভ্যতার সংখ্যা নির্ধারণ করে।
সেই বিখ্যাত সমীকরণটি হচ্ছে- N=R∗⋅fp⋅ne⋅fi⋅fl⋅fc⋅L
যেখানে,
N=মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্ত সেই সকল সভ্যতাসমূহ যাদের দ্বারা প্রেরিত তাড়িতচৌম্বক নিঃসরণগুলো চিহ্নিত করা যায়। এর ফলে তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
R∗=বুদ্ধিমান প্রাণের উৎপত্তির জন্য অনুকূল পরিবেশ বিশিষ্ট তারাসমূহ সংগঠনের হার।
fp=সেই সকল তারার ভগ্নাংশ যাদের একটি গ্রহ ব্যবস্থা রয়েছে।
ne=যে সকল তারার গ্রহব্যবস্থা রয়েছে সে সকল তারাপ্রতি গ্রহসমূহের সংখ্যা যাতে জীবন সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
fl=যে সকল গ্রহে জীবন সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ থাকার কারণে সত্যিই প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের ভগ্নাংশ ।
fi=সে সকল প্রাণশীল গ্রহসংখ্যার ভগ্নাংশ যে সকল গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর বিচরণ রয়েছে।
fc= সে সকল প্রাণশীল গ্রহসংখ্যার ভগ্নাংশ যে সকল গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীরা প্রযুক্তির এতোটুকু উন্নয়ন ঘটিয়েছে যা দ্বারা মহাকাশে সংকেত পাঠানোর মাধ্যমে তারা নিজেদের উপস্থিতির কথা জানান দিতে পারে।
L= সে সময়কাল যে সময়কাল ধরে সেই বুদ্ধিমান প্রাণীরা তাদের উপস্থিতির প্রমাণস্বরুপ নির্ণয়যোগ্য সংকেত পাঠাতে পারে।
ড. ফ্রাঙ্ক ড্রেক ও তাঁর সহকর্মিরা ১৯৬১ সালে এই সব চলকের কিছু আনুমানিক মান নির্নয় করেন। এইসব আনুমানিক মানগুলো হলো-
R∗=1year−1; এর মানে হচ্ছে বুদ্ধিমান প্রানের উৎপত্তির জন্য অনুকূল পরিবেশ বিশিষ্ট 1 টি তারা প্রতি বছর গঠিত হয়।
fp=0.2থেকে 0.5; এর মানে হচ্ছে মোট তারার পাঁচ ভাগের এক ভাগ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত তারাদের একটি গ্রহ ব্যাবস্থা থাকবে।
ne=1থেকে 5; এর মানে হচ্ছে যেসকল তারার গ্রহব্যাবস্থা রয়েছে তাদের মধ্যে 1 থেকে 5 টি গ্রহে জীবন সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
fl=1; এর মানে হচ্ছে উপরের চলক হতে প্রাপ্ত গ্রহের মধ্যে শতকরা ১০০ ভাগ গ্রহেই প্রানের আবির্ভাব ঘটতে পারে।
fi=1; এর মানে হচ্ছে উপরের চলক হতে প্রাপ্ত গ্রহের মধ্যে শতকরা ১০০ ভাগ গ্রহেই বুদ্ধিমান প্রানের আবির্ভাব ঘটতে পারে।
fc=0.1থেকে 0.2; এর মানে হচ্ছে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ প্রান মহাকাশে সংকেত প্রেরনের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
L=1,000থেকে 100,000,000বছর ; এর মানে হচ্ছে বুদ্ধিমান প্রানিরা তদের উপস্তিতির প্রমাণস্বরূপ সংকেত পাঠাতে ঐ পরিমান সময় লাগবে।
এইসব মান বসিয়ে N.এর যে সর্বনিম্ন মান পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে 20 এবং সর্বোচ্চ মান হচ্ছে 500,000,000. এইসব মানই আনুমানিক। তো এইসব মানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অনুমান করে নিতে পারে আমরা কি কখনো বুদ্ধিমান প্রানের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো.এই সমীকরণ দ্বারা আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কি ওয়েতে উপস্থিত মোট এলিয়েন সভ্যতার সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব। সমীকরণটি এতোই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, একে অনেক সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের বা আরো নির্দিষ্টকরে বললে, সেটি’র অপর নাম বলা হয়। এই সূত্রের তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করলে মনে হবে যে আমাদের গ্যালাক্সি এলিয়েনে পূর্ণ! তাই তো সূত্রটি প্রকাশের পরপরই এটি নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সে সময় থেকে এই সমীকরণের উপর অসংখ্য গবেষণা হয়েছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যটি হলো ২০১৬ সালের অ্যাডাম ফ্রাংক এবং উড্রাফ সুলিভানের গবেষণা, যা ‘অ্যাস্ট্রোবায়োলজি’ জার্নালে প্রকাশিত হয়।
একটি গ্রহ তার আয়ুর শতকরা কতটুকু অংশে প্রযুক্তির শীর্ষে থাকে? পৃথিবীতে, রেডিও এস্ট্রোনমিতে সক্ষম সভ্যতা আছে মাত্র কয়েক দশক ধরে, যেখানে এর আয়ু কয়েক বিলিয়ন বছর। আগামীকালই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার সম্ভাবনাটাও তুচ্ছ না। এটাই যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে f_L হবে কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যে মাত্র কয়েক দশক। ১০০ মিলিয়নের প্রায় ১ ভাগ…খুবই ছোটো সংখ্যা। তাহলে N হবে ১ বিলিয়নের শত মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ। অর্থাৎ, N হচ্ছে মাত্র ১০ টি সভ্যতা। ক্ষুদ্র, নগণ্য, করুণ কয়েকটা মাত্র প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সভ্যতা, বিশাল এই ছায়াপথে। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর লেগে যায় বিবর্তনের পথ ধরে সভ্যতার উত্থান হতে। এরপর হেলাফেলার এক তুড়িতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় চিরতরে। এমনটাই যদি সবখানে ঘটে, বাকি থাকবে খুব অল্পই।কে জানে, কথা বলার মত হয়তো কেউই থাকবে না,কিন্তু বিকল্পটা চিন্তা করুন। মাঝে মাঝেই কিছু সভ্যতা উচ্চ প্রযুক্তির সাথে বাঁচতে শিখে নিচ্ছে। টিকে যাচ্ছে ভূ-তাত্ত্বিক, এমনকি নাক্ষত্রিক বিবর্তনের সময়কাল।
যদি ১% সভ্যতাও প্রযুক্তির উদ্দাম কৈশোর সামলে উঠতে পারে তাহলে f_L এর মান ১/১০০ মিলিয়ন হবে না, ১/১০০ হবে শুধু। আর তখন সভ্যতার সংখ্যা দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন x ১/১০০. তখন ছায়াপথের সভ্যতার সংখ্যা হিসাব করা হবে মিলিয়নে। মিলিয়ন মিলিয়ন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সভ্যতা! তাই সভ্যতা যদি নিজেকে রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি আবিষ্কারের পরপরই ধ্বংস না করে ফেলে, তাহলে হয়তো অন্তরীক্ষ গুণগুণ করছে দূর নক্ষত্র থেকে আসা বার্তা দিয়ে। এমন এক সভ্যতার বার্তা, যা আমাদের চেয়ে অনেক প্রাচীন, অনেক বিজ্ঞ।
ফ্রাংক ডোনাল্ড ড্রেক ১৯৩০ সালের ২০ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন একটি চার্চে, মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন শিকাগোর একটি নামকরা মাধ্যমিক স্কুলে। ১৭ বছর বয়সে নেভি স্কলারশিপ জিতে সেখানে পড়ালেখা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে বিমানবাহিনীতে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখলেও পরে তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং হার্ভার্ডে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়া শুরু করেন। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে বের হতে হতে তিনি এলিয়েন বিষয়ক গবেষণার প্রতি একপ্রকার নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডঃ ফ্রাঙ্ক ড্রেক ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড থেকে স্নাতক শেষ করেই চাকরি পান পশ্চিম ভার্জিনিয়ার গ্রিন ব্যাংক এ অবস্থিত ‘ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরি’তে। জ্যোতির্বিদ হিসেবে এটাই ছিল তার হাতেখড়ি। গ্রিন ব্যাংকের ৮৫ ফুট লম্বা রেডিও টেলিস্কোপটি ছিল সে সময়ের অন্যতম অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ, যা দ্বারা ১২ আলোকবর্ষ দূর থেকে প্রেরণ করা বেতারতরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব ছিল।এমন উন্নত টেলিস্কোপের সাথে কাজ করবার সুযোগ পেয়ে ড্রেকের মনের সুপ্ত স্বপ্ন প্রবলভাবে জেগে উঠলো। এক বছরের মধ্যে তিনি সহকর্মীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে মানুষের গবেষণা করা উচিৎ। অবজারভেটরির সকলের মধ্যে চুক্তি হলো, তারা গ্রিন ব্যাংকের টেলিস্কোপ দ্বারা রুটিন কাজের পাশাপাশি এলিয়েন খোঁজার কাজ চালিয়ে নেবেন।
প্রজেক্ট ওজমায় তিনি ৮৫ ফুট দৈর্ঘে্যর ছোট টেলিস্কোপ দিয়ে বহির্জাগতিক বেতার সংকেত অনুসন্ধান করতেন। পরে তিনি সাইক্লোপস প্রজেক্টেও কাজ করেন। প্রজেক্ট ওজমা আর সাইক্লোপস প্রজেক্ট বা বর্তমান সেটি ( SETI) প্রযুক্তির মধ্যে যে তফাত, তা অনুমান করতে পারলেই ফ্রাঙ্ক ড্রেকের কর্মনিষ্ঠা বোঝা যায়। পাশাপাশি বহির্জাগতিক সভ্যতা অনুসন্ধানে তাঁর স্বপ্নের গভীরতা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারা যায়। প্রজেক্ট ওজমার মধ্য দিয়ে তিনি প্রথম বহির্জাগতিক সভ্যতার সংকেত অনুসন্ধানে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করেন। তাঁর এ চেষ্টা ব্যর্থ হলেও আজকের ‘সেটি’ প্রজেক্ট কিংবা সাইক্লোপস প্রজেক্টের জন্ম সেখান থেকেই। এসব প্রকল্পে প্রজেক্ট ওজমার পদ্ধতিগুলোই ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফ্রাঙ্ক ড্রেক উদ্ভাবিত ড্রেক সমীকরণটি ব্যবহার করে পরে কার্ল সাগান সূর্যের মতো ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র-অধ্যুষিত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকার একটি অনুকল্প তৈরি করেছিলেন। এ অনুকল্পের হাত ধরেই আজ আমাদের পথচলা।ড্রেক সমীকরণের মাধ্যমে এক ভবিষ্যদ্বাণীতে কার্ল সাগান বলেছেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি গ্রহ আছে। তার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার কোটি গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ঘটা সম্ভব। আর ১ কোটি গ্রহে বেতার টেলিস্কোপের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাযুক্তিক সভ্যতা থাকতেই পারে। অন্তত ড্রেকের সমীকরণ তা-ই বলে.
২৪ বছর ধরে সৌরজগতের বাইরে দূর নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তনরত একের পর এক গ্রহ আবিষ্কার এ সম্ভাবনাকেই জোরালো করে চলেছে। তাই একটা সাধারণ যোগাযোগব্যবস্থা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পানি সৃষ্ট জীবদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ওয়াটার হোলের মধ্যকার সব বেতার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যকে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা বলেই মনে হয়।তাদের এই পরিকল্পনার নামকরণ হলো প্রোজেক্ট ওজমা। সিদ্ধান্ত হলো, যতদিন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না হবে, ততদিন এই প্রোজেক্ট চালিয়ে নেয়া হবে সকলের অগোচরে। কারণ, এই পরিকল্পনার কথা জানাজানি হলে তা হাসির খোঁড়াকে পরিণত হতে পারে, এমন আশংকা ছিল। কিন্তু ১৯৬০ সালের ৮ এপ্রিল শুরু হওয়া এই প্রোজেক্টের কথা কিছুকাল পরই সংবাদমাধ্যমে চলে আসে। প্রাথমিকভাবে উপহাসের শিকার না হলেও, সাফল্যের অভাবে দ্রুতই তা বন্ধ হয়ে যায়।এই হচ্ছে প্রোজেক্ট ওজমার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
পিয়ারম্যান প্রাথমিকভাবে ড্রেক, তার সকল সহকর্মী এবং আমন্ত্রিত কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সাথে একটি কনফারেন্স আয়োজনের পরামর্শ দেন, যেখানে প্রোজেক্ট ওজমা নিয়ে আলোচনা হবে। এই কনফারেন্সে একটি মজার ঘটনা ঘটে, যার জন্য অনেকেই ড্রেককে মজা করে ‘জ্যোতিষী’ ডাকতেন। বর্তমানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তাছাড়া ৮৭ বছর বয়সী ড্রেক, এখনো সেটি’র ‘বোর্ড অব ট্রাস্টি’তে কাজ করে চলেছেন। জ্যোতির্বিদ্যায়, বিশেষ করে সেটি’তে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Leave a Reply