“মানব বলিদান”- ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত অধ্যায়!

রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে প্রাচীন কর্তৃপক্ষ বলির আয়োজন করতো। প্রত্নতত্ত্বীয় অনুসন্ধানে উৎসর্গীকৃত পশুর হাড়ের সংগে বিপুল সংখ্যক শিশুর হাড় পাওয়া গেছে। প্লুতার্ক (৪৬-১২০খ্রিষ্টাব্দ) বলি প্রথার প্রচলন করেন, যেমনটি হতো তার্তুলিয়ান, ওরোসিয়াস, ডিয়োডোরাস সিকুলাস এবং ফিলোর ক্ষেত্রে। তারা বর্ণনা করেন শিশুকে আগুনে ঝলসে মেরে ফেলতো।

মানব বলিদান.jpg

মানব বলিদান,Image Credit: Theatlantic.Com

ধর্মের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে হত্যা করে বলিদান করা হয়। স্রষ্টা বা স্রষ্টাসমূহ অথবা প্রকৃতির গতি পরিবর্তনের জন্য অনেক ধর্মের অনুগামীগণ মানুষ বলিদান করত । এটা বলিদানে অংশ নেওয়া সংস্কৃতিতে সামাজিক বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে কারণ উৎসর্গ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের খাওয়ার জন্য ভোজ্য মাংস বণ্টন করা হয়। হিন্দু, হিব্রু থেকে গ্রীক ও রোমীয় (লুস্ত্রাশিওর পবিত্র হওয়ার উৎসব), প্রাচীন মিশরীয় (আপিসের অর্চনা) এবং আজটেক থেকে ইয়োরুবা সকল ও সংস্কৃতির মানুষ বলি প্রথা পালন করে এবং করেছে।

ধর্মের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে হত্যা করে বলিদান.jpg

ধর্মের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ভাবে হত্যা করে বলিদান,Image Credit: LiveScience.Com

অসুস্থের রোগমুক্তি এবং ওড়িশা দেবতার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য উড়িষ্যায় স্যানতারিয়া এবং অন্যান্য বংশানুক্রম বলি করে থাকে। স্যানতারিয়ায় ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বলি দেওয়া হয় যার মধ্যে আছে পূজা, অর্চনা, দান। গ্রীসের গ্রামীণ খ্রিস্টানেরা অর্থোডক্স সাধুদের উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে থাকে যা কৌরবানিয়া নামে পরিচিত। প্রকাশ্যে এই আচার নিষিদ্ধ হলেও প্রায়ই সহ্য করতে হয়।

নরবলি হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায় কিংবা ক্রুদ্ধ দেবতাকে শান্ত করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার যা বিভিন্ন সভ্যতায় অঙ্গীভূত ছিল কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় অবসিত হয়েছে। পৃথিবীর প্রধান ধর্মসমূহে নরহত্যা তথা নরবলির বিধান নেই, বরং নরহত্যা নিষিদ্ধ। নরহত্যার সঙ্গে নরবলি’র পার্থক্য হলো নরবলি সামাজিকভাবে অনুমোদিত মানুষ হত্যা যার উদ্দেশ্য দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জ্ন। পাঁচ হাজার বছর আগে আদি ইয়োরোপের কৃষিভিত্তিক সমাজে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল। অপরাধের কারণে বিচারাদেশ অনুযায়ী হত্যা বা দেবতার সন্তুষ্টি অর্জ্জনের জন্য আত্মহত্যা নরবলি হিসাবে গণ্য নয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০-১১০০ সাল ব্যা্পী ক্যানানাইটিস, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-১০০ সাল ব্যাপী এত্রুস্ক্যানস্‌, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-১ সাল ব্যাপী কেল্টস্‌ এবং ৫০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বিস্তৃত আযটেক সভ্যতা। কখনো কখনো গণ নরবলিও সংঘটিত হতো, যেমন ফেরাউনদের রাজত্ব কালে। নরবলিতে নির্গত রক্তকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো; নরবলির রক্ত দিয়ে উপাসনা স্থান পরিষ্কার করণের রীতিও প্রচলিত ছিল।। মায়া সভ্যতায় শিরশ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে উৎসর্গীকৃত ব্যক্তির হৃৎপিণ্ড বের করে ফেলার রীতি ছিল।

বাহরাম জমাদার অল্পের জন্যে এক হাজার খুন তিনি করতে পারেননি, ৯৩১ এ থেমে গেছেন। ওনাকে নিয়ে বলিউডে সিনেমা বানানো হয়েছে। বাহরাম একজন ঠগি ছিলেন। ঠগিরা মানুষহত্যায় খুবই দক্ষ ছিল। হলুদ রুমাল ভাঁজ করে গলায় পেঁচিয়ে মানুষ মেরে ফেলত, একজন পিছন থেকে মাথা ধরে রাখত, একজন চেপে ধরে রাখত পা। পায়ের হাড় আর শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়ে লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলতো।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক (ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল) জোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার চিফ এজেন্ট ক্যাপ্টেন উইলিয়াম স্লিম্যান বেশ কয়েকটি রাজপরিবারের কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ঠগিদের নির্মূল করেছিলেন। ১৮৩১ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ৩,২৬৬ ঠগি ধরা পড়ে, যাদের মধ্যে ৪১১ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।ঠগিরা ছিল দেবী কালীর উপাসক, নির্দোষদের হত্যাকে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে দেখত। তারা বিশ্বাস করেছিল যে হত্যার বিষয়টি কালীকে সন্তুষ্ট করবে।

বিশ্বের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় যেসব বিষয় মনুষ্যত্বকে কলঙ্কিত করেছে, ‘নরবলি’ সেগুলোর মাঝে নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয়। সেই খ্রিস্টপূর্ব সময়কাল থেকে শুরু করে এই একবিংশ শতকেও পাওয়া গেছে নরবলির বিভিন্ন নমুনা-

মেক্সিকোর বছর খুঁজে পেয়েছেন ‘ফ্লেইড লর্ড’ বা ‘চামড়া ছেলা দেবতার’ প্রথম মন্দির। এই দেবতাকে মুলত ফসলের সৌভাগ্যর জন্য পূজা করা হতো সেদেশে স্প্যানিশ উপনিবেশ তৈরির আগে। এই দেবতাকে চামড়া ছেলা মানুষের অবয়বে দেখা হতো। এমন চেহারার মূর্তি পাওয়া যায় ওই মন্দিরে।

 

চামড়া ছেলা দেবতার মন্দির.jpg

চামড়া ছেলা দেবতার মন্দির,Image Credit: kalerkantho.com

মেক্সিকোর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যানথ্রপোলজি অ্যান্ড হিস্টোরি জানিয়েছে, মেক্সিকোর পুয়েবলা রাজ্যের পোপোলোকা ধ্বংসাবশেষ খনন করে এই মন্দির পেয়েছেন তারা। এখান থেকে পাথরে খোদাই করা দুইটি মাথা ও একটি ধড় পাওয়া যায় যা ওই দেবতার মূর্তির অংশ বলে তারা মনে করছেন। দেবতাটির নাম ছিলো জিপে টোটেক।এই দেবতার সেবকরা পূজার জন্য মানুষ বলি দিত ও তারপর তাদের ছিলে নেওয়া চামড়াটা গায়ে পরত। এতে ফসলের উপকার হয় ও সন্তান জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে বলে তারা মনে করত।

পোপোলোকা জাতীর মানুষ এই মন্দির তৈরি করে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে ১২৬০ সালের মাঝে এবং পরবর্তীতে আজটেক সভ্যতা এই মন্দির দখল করে নেয়। প্রাচীন নথি থেকে জানা যায়, গ্ল্যাডিয়েটর ধরণের লড়াইয়ে বা তীর ছুঁড়ে মানুষ মারা হতো পূজার জন্য। এরপর তাদের দেহের চামড়া ছিলে ফেলা হতো।এই দেবতা ও তার পূজার বিষয়ে অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার নথি রয়েছে। এমনকি আজটেকরাও তার বিষয়ে জানত। তবে পরিপূর্ণ একটি মন্দির পাওয়া গেল এই প্রথম। দেবতার মূর্তিটি এমনভাবে তৈরি যে দেখে মনে হয় সে একটি মানুষের চামড়া গায়ে দিয়ে আছে। এটাই ওই সংস্কৃতির বড় একটি নিদর্শন।

প্রাচীন বিশ্বে অন্যতম সমৃদ্ধিশালী এবং একইসাথে ক্ষমতার অধিকারী ছিলো কার্থেজের অধিবাসীরা। কিন্তু এরপরও তাদের মাঝে এমন কিছু অদ্ভুত রীতিনীতি প্রচলিত ছিলো যা তৎকালীন অনেকের কাছেই বেশ বর্বর হিসেবে ঠেকতো। এর মাঝে অন্যতম ছিলো শিশুবলি দেয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তেই তারা সেসব করতো। আরেকদিক দিয়ে ঘৃণ্য এ কাজটি তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। কার্থেজের ধনী লোকেরা তাদের সম্পত্তির সুরক্ষার জন্য নিজেদের সন্তানদেরকে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতো।

কার্থেজ নগরী.jpg

কার্থেজ নগরী,ছবি সুত্রঃ গুগল

অনেকেই অনুমান করে থাকেন ৮০০ থেকে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত (এ সময় রোমানরা কার্থেজ দখল করে নেয়) কার্থেজের আনুমানিক ২০,০০০ শিশুকে হত্যা করা হয়েছিলো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলি দিতে গিয়ে। তবে করে থাকেন অনেক ঐতিহাসিক। তাদের মতে সেই শিশুদের অনেকে প্রাকৃতিক কারণেই মারা গিয়েছিলো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নরবলি প্রচলিত ছিলো ইসরায়েলে।সেখানকার অধিবাসীরা তাদের শিশুদেরকে পুড়িয়ে এ বলিদানের কাজটি সারতো। আর যে দেবতার উদ্দেশ্যে এমনটি করা হতো, তার নাম ছিলো মলোখ। তবে তাদের সবাই যে এমনটা করতো সেটা না। এক গুপ্ত সংঘের সদস্য, যারা মলোখকে তাদের দেবতা হিসেবে মানতো, তারাই এমনটা করে থাকতো। তবে এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন অনেক ইতিহাসবিদই। তাই আজও এর সত্যতা রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।

প্রাচীন ইতালির বেশ সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান এক সভ্যতার নাম “এট্রুস্কান সভ্যতা“। টুস্কানি, পশ্চিম আম্ব্রিয়া ও উত্তর লাজিওতে ছিলো তাদের বসবাস। মূলত কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই জীবিকা উপার্জন করতো তারা। কার্থেজ ও গ্রীসের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। পাশাপাশি বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যও তাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতো।

এমন একটি সভ্যতার মাঝেও যে নরবলির মতো বিষয়টি প্রচলিত থাকবে, তা অনেক ইতিহাসবিদই মানতে চান নি। তবে ইউনিভার্সিটি অফ মিলানের একদল প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণায় সেটারও প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো।টার্কুইনিয়াতে তারা এমন কিছু বলি দেয়া মানুষের কবরের সন্ধান পেয়েছিলেন। এদের মাঝে ছিলো শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা যারা অসুস্থ, নিম্ন সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন কিংবা ভিনদেশী ছিলো।

বেশ সাধারণ একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো চায়নায় এবং এর সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটেছিলো শ্যাং রাজবংশের শাসনামলে। তখন অবশ্য এত বৃহৎ পরিসরে সংঘটিত নরবলির দুটো উদ্দেশ্য ছিলো- রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খতম করা এবং স্রষ্টার মনোরঞ্জন করা।চীনের সেই নরবলিগুলো হতো তিন রকমের। মাটিতে গর্ত করে উৎসর্গ করা হতো যুবকদের। তাদের সবারই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা থাকতো, সাথে থাকতো না নিজেদের ব্যবহার্য কোনো জিনিসও। বিভিন্ন স্থাপনায় বলি দেয়া হতো শিশুদের। তাদের মৃত্যুটা কার্যকর করা হতো বেশ মর্মান্তিক উপায়ে। কিছুটা আলাদা জায়গায় বলি দেয়া হতো কিশোরী ও তরুণীদের। অবশ্য প্রথম দু’শ্রেণীর মতো তাদের মৃতদেহের করুণ অবস্থা হতো না। দুর্ভাগা সেই কিশোরী ও তরুণীদের মৃতদেহের সৎকার ঠিকমতোই করা হতো।

এককালে মনে করতো নরবলি দেয়ার মাধ্যমে তারা যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার দেবতা ‘কু’-এর আশীর্বাদ লাভ করতে পারবে, প্রতিপক্ষকে হারাতে পারবে নানা যুদ্ধে। এ আশায় তাদের মন্দিরগুলোতে চলতো নরবলি, যেটিকে তারা বলতো ‘হেইয়াউ’। সাধারণত বিভিন্ন প্রতিপক্ষ গোত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, যারা যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলেন, তাদেরকেই বলি দেয়ার জন্য বেছে নেয়া হতো।এজন্য সেই দুর্ভাগাকে কোনো কাঠের ফ্রেমে প্রথমে উল্টো করে ঝোলানো হতো। তারপর তাকে এমনভাবে পেটানো হতো যে তাতেই বেচারার প্রাণপাখি উড়াল দিতো। অতঃপর লোকটির নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলা হতো। বলি কিন্তু ততক্ষণে মাত্র অর্ধেক সম্পন্ন হয়েছে। এবার সেই মৃতদেহ হয় রান্না করা হতো কিংবা কাঁচা খাওয়া হতো। খাদকদের মাঝে থাকতেন পুরোহিত ও গোত্রপতিরা।

বর্তমান ইরাকের অধিকাংশ, কুয়েত, সিরিয়ার পূর্বাঞ্চল, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং তুর্কি-সিরীয় ও ইরান-ইরাক সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো এককালে ছিলো। এখানকার অধিবাসীদের মাঝেও নরবলির প্রথা প্রচলিত ছিলো। রাজসভার সভাসদবর্গ, যোদ্ধা ও চাকরদেরকে তাদের মালিকের সাথে কবর দেয়া হতো যেন পরকালেও তারা তাদের মালিকের সেবা-যত্ন করতে পারে। যোদ্ধাদের সাথে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে দেয়া হতো, অপরদিকে চাকরদের মাথায় শোভা পেতো পাগড়ি।অনেকদিন ধরেই ঐতিহাসিকেরা মনে করতেন এই লোকগুলোকে মারতে বিষ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে এ ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দুর্ভাগা সেই মানুষগুলোকে মারতে তাদের মাথায় বর্শা ঢুকিয়ে দেয়া হতো!

নরবলির পেছনে ছিলো বেশ অদ্ভুত “অ্যাজটেক” অধিবাসীদের । তারা মনে করতো তাদের দেয়া এই নরবলিই সূর্যকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে! বলির শিকার হওয়া মানুষের রক্তকে তারা বেশ পবিত্র মনে করতো। তাদের বিশ্বাস ছিলো এই রক্ত তাদের সৌরদেবতা হুইতজিলোপোখ্‌তলির রাগ প্রশমন ও পুষ্টির জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।অ্যাজটেকদের নরবলি দেয়ার প্রথাটা ছিলো বেশ ভয়াবহ। এতে স্বেচ্ছাসেবীদের পাশাপাশি যুদ্ধবন্দীদেরও ব্যবহার করা হতো। কখনো কখনো বলি দিতে চাওয়া মানুষটিকে প্রথমে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো মন্দিরে। সেখানে অবস্থানরত পুরোহিত লোকটির গলা থেকে শুরু করে একেবারে পেট পর্যন্ত চিরে ফেলতেন! এরপর লোকটির হৃদপিণ্ড উৎসর্গ করা হতো দেবতার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে দেহের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হতো।

নরবলির এ প্রথা মিশরে।সেখানে একজন দাস বা ফারাওয়ের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীকে তার সাথে কবর দেয়া হতো যেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনেও তিনি তার মনিবের সেবা করে যেতে পারেন। ইজিপ্টোলজিস্ট জর্জ রেইজনার জানিয়েছেন, রাজা জার ও আহার কবরগুলো তাদের ভৃত্যদের দিয়ে পরিপূর্ণ ছিলো। সেই ভৃত্যদের সাথে দেয়া হয়েছিলো বিভিন্ন দরকারি জিনিসপত্র যাতে পরকালে মনিবের সেবা করতে কোনোরুপ অসুবিধা না হয়!

স্রষ্টার সন্তুষ্টির নিমিত্তে নরবলি দিতো ইনকা সভ্যতার লোকেরা । এজন্য তারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতো শিশুদের। প্রায়ই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতো ইনকা সাম্রাজ্য। তারা মনে করতো কেবলমাত্র নরবলির মাধ্যমেই এসব দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে প্রাণ হারাতে হতো ইনকা শিশুদের।আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তাদের সমাজে এমন অনেক শিশুও ছিলো যাদের বড় করার উদ্দেশ্যই ছিলো কেবল বলি দেয়া! এসব শিশুদের বলির ব্যাপারকে ইনকারা ‘সবচেয়ে পবিত্র বলি’ হিসেবে মনে করতো। তারা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর এ শিশুরা অনেক সুন্দর এক জীবনের অধিকারী হবে। অবশ্য মৃত্যুর আগে তাদের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করা হতো। তাদেরকে দেয়া হতো পছন্দসই খাবার, এমনকি মিলতো সম্রাটের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্যও।

ইনকা সভ্যতা.jpg

ইনকা সভ্যতা,Image Credit: Google

যদিও আজকের লেখায় উল্লেখ করা প্রতিটি বর্ণনাই বেশ কষ্টদায়ক, তবে আরো বেশিই কষ্টদায়ক। সেখানে এককালে নিয়ম ছিলো স্বামী মারা গেলে তার স্ত্রীকেও শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে হবে। সেখানকার নানা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী বেশ গুরুত্বের সাথেই এ নিয়মটি অনুসরণ করতো। তারা বিশ্বাস করতো স্ত্রীর কর্তব্য হলো ইহকালের পাশাপাশি পরকালেও স্বামীকে সঙ্গ দেয়া। এজন্য স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার সকল স্ত্রীকেই বলির শিকার হতে হতো।বিধবা এ সকল নারীকে বলা হতো ‘থোথো’, যার অর্থ ‘স্বামীর কবরের গালিচা’! আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো নারীদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করার দায়িত্বটি পালন করতো তাদের আপন ভাইয়েরা। সেটা না করতে পারলে অন্তত নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী তাকে অবশ্যই হওয়া লাগতো।

পশ্চিম আফ্রিকার পুরনো এক রাজ্যের নাম ছিলো ডাহোম। সেখানে বার্ষিক এক উৎসবের নাম ছিলো জোয়েতানু। জোয়েতানুতে নানা ধরনের আয়োজনের পাশাপাশি অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিলো নরবলি। এজন্য বেছে নেয়া হতো দাস-দাসী ও বিভিন্ন যুদ্ধবন্দীদের। জীবিত ও মৃত রাজাদের সম্মানার্থে সংঘটিত এ নরবলি কার্যকর করা হতো মূলত শিরশ্ছেদের মাধ্যমে। এটা এতই বহুল প্রচলিত এক চর্চা ছিলো যে, শুধুমাত্র এক রাজার শাসনামলেই আনুমানিক ৭,০০০ লোক এ জোয়েতানুর নরবলিতে মারা যায় বলে জানা গেছে।

প্রাচীনকালে এ প্রথা অনুসরণকারীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছিলো মায়া। বিশেষ কোনো উপলক্ষে তারা এমনটা করতো। নরবলিগুলো মাঝে মাঝে দেয়া হতো মন্দিরে। দুর্ভাগারা অধিকাংশ থাকতো বিভিন্ন যুদ্ধবন্দী। চিচেন ইৎজাতে নরবলি দেয়ার সময় বৃষ্টির দেবতা চাকের সম্মানার্থে বন্দীদের গায়ে নীল রঙ মাখা হতো। এরপর তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হতো কোনো কুয়ায়।

প্রথার অস্তিত্ব ছিলো আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই,এটি সতীদাহ প্রথা নামে।এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন নারী বিধবা হবার পর স্বামীর সাথে সহমরণে চিতায় যাবার বিষয়টিকেই বলা হয় সতীদাহ। নারী কখনো যেতেন স্বেচ্ছায়, কখনো বা জোরপূর্বক তাকে পাঠানো হতো। বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে অমানবিক এ প্রথার অবসান ঘটে।তবে এখনো এর অস্তিত্ব একেবারে মিলিয়ে যায় নি। ২০০৬ সালে জানা যায়, ভারতের মধ্যপ্রদেশের তুসলিপার গ্রামের চল্লিশ বছর বয়স্কা এক নারী স্বামীর মৃত্যুর পর সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তবে কেউ তাকে বাধ্য করে নি। তিনি নিজেই সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলে পুলিশ জানায়।

সতীদাহ.jpg

শিল্পীর কল্পনায় সতীদাহ,Image Credit: Wikipedia.org

আজকের দিনেও অনেক ঐতিহ্যবাহী ধর্মে গোপনীয়ভাবে নরবলি প্রথা পালন করা হয। পৃথিবীর কোন দেশ নরবলি সমর্থন করে না। বর্তমান পৃথিবীতে এটা অপরাধ বলে গণ্য হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Trying to access array offset on null in /home/bcsaid/instabangla.com/wp-content/themes/disto/single.php on line 260