আসসালামু আলাইকুম, আপনাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি ওয়ালিউর রহমান। অনলাইন বিজনেস এর কিছু ভুল যেগুলো অনেকেই করে থাকেন, আজ তা নিয়ে দু-চার লাইন লিখতে যাচ্ছি। তো চলুন শুরু করি-
১। প্রোপার অডিয়েন্স টার্গেটিং না থাকাঃ
একটা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে থাকে অডিয়েন্স টার্গেটিং। কিন্তু দেখা যায় এফ কমার্স এর দোহাই দিয়ে নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা নিজেদের টার্গেট অডিয়েন্সটা স্পেসিফাই না করেই অনেক টাকা ফেসবুক বুস্টের পেছনে খরচ করে ফেলেন।
২। না বুঝে কিংবা নন প্রফেশনাল ওয়ে তে বুস্ট করাঃ
নন প্রফেশনাল ভাবে বুস্ট করতে গেলে আপনি হয়তো খরচ বাঁচাতে পারবেন, কিন্তু একইভাবে পটেনশিয়াল কাস্টমার হারাবেন। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এ অভিজ্ঞ কেউ যেই স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করবে, আপনি একজন এন্ট্রেপ্রেনিওর হিসেবে সেই স্ট্রাটিজি অবলম্বন নাও করতে পারেন। কিংবা নাও জানতে পারেন। তাছাড়া প্রফেশনাল কেউ তার কাজ টা যেভাবে করবে, সেটা ঐ বিষয়ে প্রফেশনাল না এমন কেউ সেভাবে করতে পারবে না।
৩। শুধু ফেসবুক বুস্ট করাঃ
গুগোলের রেভিনিউ ২০১৬ সালে ৮৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০১৯ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ১৬২ বিলিয়ন ডলারে। যার ৮২% ই আসে এ্যাড থেকে। অপর দিকে ফেসবুকের রেভিনিউ ২০১৬ সালে ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ এ গিয়ে দাঁড়ায় ৭০ বিলিয়ন ডলারে। যেখানে ফেসবুকের পুরো রেভিনিউটাই আসে এ্যাড থেকে। তারপরও, স্পষ্ট ভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, ফেসবুক এ্যাডের চেয়েও মানুষ বেশি আস্থা রাখছে গুগোল এ্যাড এর উপরে। হিসেব করলে যা দিগুণের চেয়েও বেশি। সুতরাং যদি ভেবে থাকেন কাস্টোমার অ্যাকুইজিশন শুধুমাত্র ফেসবুক থেকে করবেন, ভুল করবেন!
৪। ত্রুটিপূর্ণ কিংবা নন প্রফেশনাল ওয়েবসাইটঃ
ওয়েবসাইট নেই, কিন্তু আপনি অনলাইন বিজনেস করছেন; সে বিষয়টা হতেই পারে না। কারণ, ওয়েবসাইট হচ্ছে এখনকার সময়ে কেবল অনলাইন নয়, অফলাইন বিজনেসের ক্ষেত্রেও একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এখন কথা হচ্ছে, অনেকেরই ওয়েবসাইট তো থাকে, তবে দেখা যায় তা ভাল মাণের হয় না। আবার অনেক সময় বিভিন্ন ত্রুটি থেকে যায় ওয়েবসাইটে। যেটা কাস্টমারের সামনে ভাল কোন ইম্প্রেশন ক্রিয়েট করে না। অন্যদিকে একটি ওয়েবসাইটে যদি ক্লিয়ার ভাবে এবং সঠিক স্থানে একশন নিতে উদ্বুদ্ধ না করা হয়, যেটাকে আমরা কল টু অ্যাকশন বলি… সেটাও একটা বড়োসড়ো ত্রুটি হিসেবেই বলা যায়। সর্বোপরি আপনার ওয়েবসাইটের লুক, ইউজার ইন্টারফেস থেকে শুরু করে গতি পর্যন্ত সম্পূর্ণ ইউজার ফ্রেন্ডলি হতে হবে, যেন সেলস প্রপার ওয়েতে হয়।
৫। নিম্নমানের হোস্টিংঃ
অনেকেই ওয়েবসাইট এর পেছনে অনেক টাকা খরচ করে ফেলেন, কিংবা অনেক সময় বাজেট একেবারেই কম করেন। দুটোর যেটাই করেন না কেন, হোস্টিং এর বেলায় খোঁজেন বাজেট হোস্টিং। আসলে কম টাকার যেকোনো কিছুই তেমন মান সম্পন্ন হয় না। একটি ওয়েব হোস্টিং শুধু কোন সার্ভিস নয়, এটা কিন্তু আপনার ওয়েবসাইটের সিকিউরিটি এবং পারফরম্যান্স এর অন্যতম সোর্স। তাই হোস্টিং নির্ধারনে গুরুত্ব দিন। সস্তা শেয়ার্ড হোস্টিং বাদ দিয়ে, ভিপিএস কিংবা ক্লাউড হোস্টিং নিতে পারেন।
৬। নিজের কাজ নিজে করা, অন্যের কাজও নিজে করাঃ
নিজের ব্যবসা শুরু করলে সবচেয়ে ভালো যে সিদ্ধান্তটি, তা হল নিজের কাজ নিজে করা।আপনি নিজে আপনার কাজটি যেভাবে গুরুত্বসহকারে করবেন, অন্য কাউকে দিয়ে সেটা সেভাবে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকে এইটা করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করেন, তা হল- অন্যের কাজ ও নিজে করা! আপনার যে কাজের জন্য কোন লোক খাটাতে হবে, কিংবা কর্মচারী নিয়োগ দিতে হবে, সে বিষয়টাকে আপনি ইগনোর করতে পারেন না। আপনার যদি ই-কমার্স ব্যবসা হয়, তাহলে অবশ্যই আপনার একজন ডেলিভারি ম্যান নিয়োগ করতে হবে। যদি ডেডিকেটেড ডেলিভারি ম্যান নিয়োগ নাও করেন আপনার হয়তো বা ডেলিভারি সেকশনটা আউটসোর্সিং করাতে হবে। আউটসোর্সিং মানে শুধুমাত্র কম্পিউটার ভিত্তিক জব নয়।
যেকোনো কাজ কোম্পানির বাইরের কোন সোর্স থেকে করানো কেই আউটসোর্সিং বলে। আবার দেখা যাচ্ছে, আপনি প্রোডাক্ট কিনতে যদি সময় দেন সেই সময়ে কাস্টমার সাপোর্ট দেবার কেউ থাকেনা। সেরকম হলে অবশ্যই আপনার কাস্টমার সাপোর্ট ডিপার্টমেন্টে অন্য কাউকে লাগবে। আপনি যদি সে কাজটা ও নিজেই করতে যান, অন্য কাজটা হবে না। সর্বোপরি ব্যবসাতে আপনাকে সুপারভাইজার হতে হবে, সুপারম্যান নয়। একইভাবে ওয়েবসাইটও কোনো প্রফেশনাল দিয়ে ডেভলপ করাবেন। তাতে করে আপনার কাজটা যেমন সুন্দর হবে, আপনি ও আপনার বিজনেসের ফোকাস করতে পারবেন। সবার পক্ষে সব কাজ করা যেমন সম্ভব নয়, তেমন উচিৎ ও নয়!
৭। নিম্নমানের প্রোডাক্ট/সার্ভিসঃ
আপনি যেই প্রোডাক্ট কিংবা সার্ভিস নিয়ে বিজনেস করছেন, অবশ্যই সেই প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কে সবার আগে ফার্নিশড হতে হবে। অনেকেই যেনতেন প্রোডাক্ট নিয়ে মার্কেটে বিজনেস লঞ্চ করেন। যাদের সার্ভিস ভিত্তিক বিজনেস, তাদের মধ্যেও নিজের সার্ভিস সম্পর্কে জ্ঞানের লিমিটেশন লক্ষ্য করা যায়। কোন একটা সার্ভিস অরিয়েন্টেড বিজনেস যদি আপনি মার্কেটে লঞ্চ করেন, অবশ্যই আপনাকে ওই বিষয়ে প্রফেশনাল হতে হবে। মনে রাখবেন দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা সার্ভিস বিজনেসের চালিকাশক্তি। আপনি নিজে যদি এই বিষয়ে দক্ষ না হয়ে থাকেন, কিংবা আপনার পার্টনারের ও যদি বিষয়টি সম্পর্কে তেমন দখল না থাকে, তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ম্যানেজার নিয়োগ করতে হবে। যিনি পুরো বিষয়টাকে সামলাতে পারবেন।
আর অবশ্যই আপনার এবং আপনার পার্টনারের এই বিষয়টা সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান থাকতে হবে। কারন একটা মিনিমাম জ্ঞান ছাড়া কোন বিজনেস ফিল্ডে নামা উচিত নয়। আপনার কনজিউমার বিজনেস হলে, সব সময় মনে রাখবেন মৌসুমী প্রোডাক্টের বিজনেস কিছুটা এড়িয়ে চলা উচিৎ। আপনি অবশ্যই ট্রেন্ডি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করবেন। তাই বলে এমন কোন প্রোডাক্ট নয়, যেটার যোগান পরবর্তীতে আপনার হাতে থাকবে না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টা হচ্ছে, কোন কারনেই যেন আপনার রিটার্নিং কাস্টমার ছুটে না যায়। আপনি জাস্ট পাইকারি বাজারে গেলেন এবং হাতের সামনে যা পেলেন কিনে নিয়ে আসলেন, আর সেগুলোই অনলাইনে সেল করা শুরু করে দিলেন, এভাবে করে আপনি আপনার বিজনেস কে স্কেলিং করতে পারবেন না। শুধুমাত্র ট্রেডিং করে যেতে পারবেন। একটা ব্যবসার অনেক বড় অ্যাডভান্টেজ হচ্ছে তার স্কেলিবিলিটি। ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করার সুযোগ থাকতে হবে।
৮। বাজে কাস্টমার সাপোর্টঃ
খুব ভালো মানের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস দিয়ে থাকলেও অনেকে যে বড় বিষয়টা মাথায় রাখেন না, তা হচ্ছে after-sales কাস্টমার সাপোর্ট। আপনি সেল তো করলেন, কাস্টমার সাপোর্ট যদি মানসম্পন্ন না হয় তাহলে একদিকে যেমন কাস্টমার রিটেনশন ঠিক থাকবেনা। অন্যদিকে ওয়ার্ড অফ মাউথ মার্কেটিং এর অ্যাডভান্টেজ আপনি পাবেন না। কাস্টমার রিটেনশন রাখতে পারলে তো ভালো, একই কাস্টমার আপনার কাছ থেকে বারবার প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নেবে। কাস্টমারের রেফারেন্সে আরো কাস্টমার পাবেন। সুতরাং কাস্টমার সাপোর্ট এ গুরুত্ব দিন, কাস্টমারের সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করুন, সমাধান করার চেষ্টা করুন এবং সম্মান দিন।
৯। সিড ক্যাপিটাল সংকটঃ
এটা আমি সবার লাস্টে বলছি, কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় কথা। এই বিষয়টা সবার লাস্টে বলার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে,কথাটা আমি তাদের জন্য বলতে চাই যাদের যথেষ্ট ধৈর্য আছে। যারা নিজের ব্যবসা কে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং চাচ্ছেন ব্যবসাটাকে স্টেবল করতে। আমাদের দেশে যারাই কোন ব্যবসা শুরু করেন, তারা সবচেয়ে বেশি ট্রেডিং মডেল টা ফলো করেন। কারণ এটা ব্যবসার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। আপনি কোন একটা প্রোডাক্ট কালেক্ট করে সেটাকে ডিসপ্লে করবেন, সেটা সেল করে প্রফিট করবেন এবং আবার প্রডাক্ট কিনে একই প্রক্রিয়া কন্টিনিউ করবেন। এতে করে সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটা পাওয়া যায়, তাহল কোন প্যারা নাই! নিশ্চিন্তে শুধু একই কাজ করতে থাকবেন। জাস্ট একটা সাইকেল বা কাজের চক্র কন্টিনিউ করবেন।
সমস্যাটা হলো, এ ধরনের বিজনেস এ কোন ইনভেস্টমেন্ট পাবেন না। একেবারে সাদা মাটা এবং কমন বিজনেস মডেল। অন্যদিকে, আপনি ট্রেডিং করেন কিংবা ভালো মানের একটা স্টার্টআপ নিয়ে চিন্তা করেন, একটা কমন জিনিস আপনার লাগবে… তা হল টাকা। প্রাথমিক যে টাকাটা আপনার বিজনেস একেবারে শুরু করার জন্য প্রয়োজন হয়, সেই টাকাকেই বলে সিড ক্যাপিটাল। আপনি ফর্মাল ভাবে ব্যবসা করতে চাইলে অবশ্যই পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার চিন্তা পরিহার করতে হবে। আর সেজন্য প্রথম চার মাস কিংবা ছয় মাসের একটা ব্যাক-আপ প্ল্যান এবং সিড ক্যাপিটাল নিয়ে ব্যবসায় নামা উচিৎ।আপনি যদি ভাবেন অল্প কিছু প্রোডাক্ট কিনে ব্যবসা শুরু করবেন, এবং সেটাই রোটেশন করে ব্যবসা বড় করবেন, ঘটনাটা এমন নাও হতে পারে।সময়মতো প্রোডাক্ট সেল নাও হতে পারে।
অনেকে সার্ভিস বিজনেসে একই ধরনের চিন্তা করে নামেন।ভাবেন, ক্লায়েন্ট সার্ভিস দিয়ে যে ইনকাম হবে সেটা দিয়ে অফিস ভাড়া, বেতন দিয়েও লভ্যাংশ বাসায় নিতে পারবেন। আর এখানেই মেজর ভুল টা করেন। অনেকে তো টাকার এগেইনস্ট এ নিজের সময়কে সেল করেন, কিন্তু নিজের কোন বেতন ধরেন না। এটা করবেন না। সব ব্যবসাই বড় না করতে পারার পেছনে এমন অনেক ছোট ছোট ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী হয়ে থাকে। মনে রাখবেন, বিনা পয়সায় বিজনেস করতে পারার পেছনে অনেক মানুষের সাহায্য এবং আস্থার প্রয়োজন হয়… যেটা ব্যবসার শুরুতেই অর্জন হয় না। তাই নিজের একটা ব্যাকআপ নিয়ে তবেই নামুন! শুভ হোক আপনার পথচলা।লেখক: Muhammad Waliur Rahman হেড অফ মার্কেটিং, CodeXeon
Leave a Reply