মার্ক জাকারবার্গ, পুরো বিশ্বকে একসাথে যুক্ত করার লক্ষ্যে যিনি প্রতিষ্ঠা করেন ফেসবুক। সম্প্রতি সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতা দিতে তিনি ফিরেছিলেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডে। ৩০ মিনিটের এই বক্তৃতায় জাকারবার্গ তরুণদের সফলতার জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়ার পাশাপাশি আজকের আধুনিক বিশ্বে তরুণদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করেছেন।
“প্রথমত, এই জায়গাটিকে আমি অনেক ভালবাসি। এতটা বৃষ্টির মাঝেও আজ এখানে উপস্থিত থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। আজ তোমাদের সবার মাঝে থাকতে পেরে আমি গর্বিত, কারণ তোমরা এমন একটি কাজ করে দেখিয়েছ যা আমি কখনো পারিনি, এবং তাহলো নিজের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা। আজ যদি আমি আমার বক্তৃতা ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারি, তবে সেটাই হবে হার্ভার্ডে আমার করা প্রথম কাজ যা আমি শেষ করেছি। তবে আমি আজ অবধি আমার জীবনে যা কিছু করেছি, তার মাঝে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র হতে পারার জন্য আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ করে।
হার্ভার্ডে আমার প্রথম ক্লাসের দিন তাড়াহুড়োর মাঝে আমি আমার টি-শার্টের ট্যাগ খুলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন। অবশেষ কে.এক্স.জিন নামের একটি ছেলে আমার ভুল ধরিয়ে দিল। সেই দিন থেকেই আমরা বন্ধু আর এখন সে ফেসবুকের একটি বড় অংশের দায়িত্বে আছে।
সুতরাং, আমাদের সকলেরই উচিত একে অপরের প্রতি সদয় হওয়া এবং সহযোগিতা করা। আমি হার্ভার্ড থেকে পুরো জীবনের জন্য কিছু বন্ধু পেয়েছি, তাই হার্ভার্ডের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজ এখানে উপস্থিত সবাইকে আমার অভিনন্দন। আমরা সবাই একই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত, তাই আজ আমি কথা বলব কীভাবে আমাদের এই প্রজন্ম একটি নতুন পৃথিবী তৈরি করতে পারে।
তোমাদের জীবনের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত তা বলার আমি কেউ নই। আমরা সবাই আমাদের নিজেদের জীবনের লক্ষ্য কী তা জানি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে শুধুমাত্র নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়াই যথেষ্ট নয়। আমাদের জেনারেশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এমন একটি পৃথিবী গড়ে তোলা যেখানে প্রতিটি মানুষেরই নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করার সামর্থ্য আছে।
আমার খুব প্রিয় একটি অণুগল্প হলো, প্রেসিডেন্ট কেনেডি একদিন নাসার সদরদপ্তরে গিয়ে দেখতে পায় একজন লোক একটি ঝাড়ু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কেনেডি ঐ লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কী করছ?”। লোকটি উত্তর দিল, “জনাব প্রেসিডেন্ট, আমি একজন মানুষকে চাঁদে অবতরণ করতে সাহায্য করছি”।
লক্ষ্য হলো এমন একটি অনুভূতি যার ফলে তুমি নিজেকে তোমার থেকেও অনেক বড় কিছুর অংশ মনে করবে। এর থেকে তুমি নিজের সামর্থ্যের চেয়েও বড় কিছু করার অনুপ্রেরণা পাবে। তোমার লক্ষ্যই তোমাকে প্রকৃত সুখের অনুভূতি দিবে। আমাদের বাবা-মায়েদের সময়ে একটি ভালো চাকরি করা, একটি ভালো সমাজের অংশ হওয়া সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু বর্তমান যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে চাকরির পরিমাণ দিন দিন কমছে। মানুষ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি একাকীত্বে ভুগছে। আমি একদিন একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের শিশুদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম যে তাদের যদি সুন্দর একটি লক্ষ্য থাকত, অবসর সময়ে করার মত কিছু থাকত তাহলে হয়তো তাদের এই পরিনতি হতো না।
আমাদের জেনারেশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নতুন কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি মানুষের মনে নতুন করে লক্ষ্য তৈরি করা। হার্ভার্ডের একটি ডর্মে বসে প্রথমবারের মত ফেসবুক চালু করার পর আমার এক বন্ধুকে বলেছিলাম, “আজ আমরা হার্ভাড কমিউনিটিকে একত্র করলাম, একদিন কেউ একজন পুরো পৃথিবীকে একত্র করবে”। সেই কেউ একজন যে আমি নিজেই হতে পারি তা আমি ভাবিনি। তবে একটি জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট ছিল এবং তা হলো পুরো পৃথিবীকে একত্র করার সময় এসে গেছে।
তোমাদের অনেকের গল্পই হয়তো আমার মতই। তোমাদের সবার চিন্তায় রয়েছে অন্তত এমন একটি পরিবর্তন যা তুমি নিশ্চিত কেউ না কেউ পৃথিবীতে আনবে, কিন্তু তারা তা আনছে না। কেননা সেই পরিবর্তনটি তোমাকে নিজেই আনতে হবে। আমি কখনো একটি কোম্পানি তৈরি করতে চাইনি, আমি আনতে চেয়েছিলাম একটি পরিবর্তন। এবং আমার ধারণা ছিল সর্বপ্রথম যারা ফেসবুকে কাজ করতে এসেছিল তাদেরও একই লক্ষ্য ছিল। কিন্তু বছর দুয়েক পর যখন বড় বড় কোম্পানিগুলো আমাদের কিনে নিতে চেয়েছিল, আমি বাদে অন্য সবাই ভেবেছিল ফেসবুককে বিক্রি করে দেওয়াই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।
কিন্তু অর্থ উপার্জন করা আমার লক্ষ্য ছিল না, আমি চেয়েছিলাম আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে কানেক্ট করতে। পরের ১ বছরের মাঝে ফেসবুকের শুরুর দিকের অধিকাংশ কর্মীই ফেসবুক ত্যাগ করেছিল। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠার পর সেই সময়টিই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। কেননা পুরো পৃথিবীকে একত্র করতে গিয়ে আমি নিজেই অনেক একা হয়ে গিয়েছিলাম।সেই সময় আমি ভাবতাম আমি ভুল করেছি, কিন্তু এখন আমি জানি বড় কোন পরিবর্তন আনতে হলে তোমাকে ঝুঁকি নিতেই হবে। তাই আজ আমি এমন ৩ টি বিষয়ের কথা তোমাদেরকে বলব যা আমার মতে পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
১. উদ্যোগ নিতে হবে:
অটোমোবাইল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে আমাদের কর্মক্ষেত্রের পরিমাণ দিন দিন কমছে যা আমাদের প্রজন্মের সামনে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কাজ করার বাইরেও আমাদের করার মত অনেক কিছুই আছে। প্রতিটি প্রজন্মই এমন কিছু কাজ করে যা তাদেরকে স্মরণীয় করে রাখে। যেমন, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম মানুষকে চাঁদে পাঠিয়েছে, বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল করেছে। এখন আমাদের প্রজন্মের পালা কিছু একটা করে দেখানোর। তুমি হয়তো ভাবছো তুমি জানোনা কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, শুরুতে কেউই জানে না কীভাবে পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হবে।
- আমরাই সেই প্রজন্ম হতে পারি যারা দারিদ্র্য ও রোগব্যাধি দূর করবে
আইডিয়া কখনো পূর্ণাঙ্গভাবে কারো মস্তিষ্কে আসে না। ছোট একটি আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করলে তা আস্তে আস্তে বড় হবেই। সুতরাং, উদ্যোগ নেওয়াই আসল। আমি যদি শুরুতে জানতে চাইতাম কীভাবে পুরো বিশ্বকে কানেক্ট করতে হয়, তাহলে আমি হয়তো ফেসবুক বানাতেই পারতাম না। তাই তোমার সেই বড় ও পূর্ণাঙ্গ আইডিয়ার জন্য অপেক্ষা না করে তোমাদের ছোট ছোট আইডিয়াগুলো নিয়েই কাজ শুরু করে দাও। উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি তোমাকে অনেক ভুল বোঝাবুঝির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে, এমনকি লোকে তোমাকে পাগলও বলতে পারে।
আমাদের সমাজে আমরা বড় উদ্যোগ নিতে ভয় পাই, কেননা এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু ভুল করার ভয়ে আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের প্রজন্মের জন্য এটাই সেরা সময় কিছু একটা করে দেখানোর। আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হওয়ার আগেই একে থামাতে পারি তবে কেমন হবে? অথবা বিভিন্ন রোগের ওষুধ আবিষ্কার না করে আমরা ঐসব রোগের নিরাময় আবিষ্কার করতে পারি! এভাবে পৃথিবীতে কোন রোগই থাকবে না, তাই আমাদের ওষুধের প্রয়োজনই থাকবে না। পুরনো আবিষ্কারের উন্নয়ন সাধন করার পাশাপাশি চলো নতুন কিছু আবিষ্কার করি।
২. আইডিয়াগুলো বাস্তবে রূপ দিতে হবে:
আমাদের জেনারেশন নতুন উদ্যোগ নিতে ভালোবাসে যা আমাদের সমাজের জন্য খুবই হিতকর। কিন্তু ভালো উদ্যোগ নেওয়া তখনই সম্ভব হবে যখন আমাদের আইডিয়াগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সহজ হবে। ফেসবুক আমার প্রথম আবিষ্কার নয়, এর আগে আমি পড়াশোনা বিষয়ক অনেক অ্যাপ ও গেইম তৈরি করেছি যেগুলোকে কেউই গুরুত্ব দেয়নি। জে.কে রাওলিং তার হ্যারি পটার সিরিজের জন্য ১২ বার অগ্রাহ্য হয়েছিলেন। এমনকি ১০০ টির বেশি গান তৈরির পর সংগীত শিল্পী বিয়ন্সে তার প্রথম গান প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। সুতরাং, বড় সফলতা অর্জনের জন্য তোমার প্রথমে ব্যর্থ হওয়াকে মেনে নেয়ার যে কৌশল তা শিখতে হবে।
একজন মানুষের আইডিয়াগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে জাতিগতভাবে আমরা সবাই হেরে যাব। আমরা সফল মানুষদের সমাদর করি, কিন্তু আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো তাদের আইডিয়া কাজে লাগাতে পারছে কিনা তার খোঁজ আমরা রাখি না। এমন অনেককেই আমি চিনি যারা তাদের দারুণ সব আইডিয়াকে কাজে লাগাতে পারছে না এই ভয়ে যে তারা একবার ব্যর্থ হলে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এমনকি ফেসবুক ব্যর্থ হলে যদি আমার আর উঠে দাঁড়াতে না পারার ভয় থাকত, তাহলে হয়তো আজ আমি তোমাদের সামনে বক্তৃতা দিতে পারতাম না।
শুধু দারুণ একটি আইডিয়া দিয়েই সফল হওয়া যায় না, সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজন আইডিয়াগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ যা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সবার উচিত একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, যেন তারা তাদের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপান্তর করতে পারে। কেননা যত বেশি সংখ্যক মানুষ তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবে, আমাদের পৃথিবী ততই এগিয়ে যাবে।
৩. একত্র হয়ে কাজ করতে হবে:
আগেই যেমনটা বলেছি, আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সকলকে নিজের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে সহায়তা করা। সকলকে বলতে আমি পুরো পৃথিবীর সবাইকে বুঝিয়েছি। এখানে উপস্থিত অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছো, এমনকি সবারই অন্তত একজন বহিরাগত বন্ধু আছে। আমরা কোন দেশের নাগরিক বা কোন ধর্মের অনুসারী তা বর্তমানে আমাদের পরিচয় বহন করে না, বরং আমাদের প্রকৃত পরিচয় হলো আমরা একজন গ্লোবাল সিটিজেন।
প্রতিটি প্রজন্মই তাদের কমিউনিটির পরিসর বৃদ্ধি করে, আর বর্তমানে পুরো বিশ্বই আমাদের কমিউনিটির অন্তর্গত। মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের এক হয়ে কাজ করার মাঝে। আমরাই সেই প্রজন্ম হতে পারি যারা দরিদ্রতা ও রোগব্যাধি দূর করবে। এবং আমরা সেই সুযোগ তখনই পাবো যখন আমরা সকলে একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারব।
বিশ্বের কোন দেশই একা জলবায়ু পরিবর্তন বা অন্যান্য রোগব্যাধি দূর করতে পারবে না, উন্নয়ন আনতে হলে আমাদের একটি গ্লোবাল কমিউনিটি হিসেবে কাজ করা আবশ্যক। পুরো পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রয়োজন নেই, তার জন্য আমরা নিজেরাই যথেষ্ট। আমাদের সমাজ আমাদেরকে বড় কিছু করার সাহস যোগায় এবং সহযোগিতা করে, এক কথায় সমাজ আমাদেরকে লক্ষ্য প্রদান করে। দুঃখের ব্যাপার হলো মানুষ দিন দিন সমাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
কিন্তু আমি জানি সমাজের প্রতি হারিয়ে যাওয়া আগ্রহ আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে পারব। ফেসবুক প্রতিষ্ঠার সময়ও আমার একই উদ্দেশ্য ছিল। হার্ভার্ডের একটি ডর্মে বসে আমি ছোট একটি কমিউনিটিকে এক করার চেষ্টা করেছিলাম, আর এখন চেষ্টা করছি পুরো পৃথিবীকে এক করতে। বিশ্বের সকল পরিবর্তনই ছোট পরিসরেই শুরু হয়েছিল। তাই আমাদের প্রজন্মের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ পৃথিবীর সকল মানুষকে একটি কমিউনিটির অন্তর্ভুক্ত করা যেখানে সকলের জীবনে একটি লক্ষ্য আছে।”তথ্য সূত্রঃ ইন্টারনেট
Leave a Reply