“জিডিপি(Gross Domestic Product)”- রামায়ণ, মহাভারত বা বাইবেলের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সূচক হিসেবে জিডিপির কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকবে না।” দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একথা বলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
আসলে তার মতে জিডিপি নিয়ে নাক সিটকানো মানুষ দুই প্রকার। এক প্রকার হল চিপায় পড়ে,অন্য প্রকার হল না বুঝে।এটা সত্য ১৯৩৪ সালের আগে জিডিপি ছিলনা। কিন্তু ব্রিটিশ পিরিয়ডে আসলে অর্থনীতি নিয়ে সেভাবে গুরুত্ব দিয়েও বিবেচনা করা হয়নি। গত শতাব্দির পুরটা সময় একটি দেশের অর্থনৈতিক মূল্যায়নে জিডিপি ছিল।
কিন্তু জিডিপি আসলে কি? কেন এটা গুরুতপূর্ন? আর কেন এটা গুরুতপূর্ন না?
একটা দেশের আয়তন বুঝতে আমরা বর্গমাইল বা বর্গ কিলোমিটার হিসাব করলেই পেয়ে যায়। কিন্তু একটা দেশের অর্থনীতির আকার বা সাইজ কিভাবে বুঝব? একটি দেশের ভেতর যত অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলছে এটার সমষ্টি কে আমরা জিডিপি বলতে পারি।আপনি এক কাপ কফি বা চা খেলেন। এটাও জিডিপিতে এড হয়। সেলুনে চুল কাটতে গেলেন সেটার ভ্যালুও এড হয়। ডাক্তার দেখালেন সেটাও এড হয়। আর্থিক মূল্যের সব লেনদেন জিডিপিতে এড হয়।
তবে জিডিপি কিভাবে হিসাব করে? এই হিসাবটা মুলত তিনটি পদ্ধতিতে করা হয়।
১. এক্সপেন্ডিচার মেথড (Expenditure Method) বা খরচ হিসাব করে।
২. আউটপুট বা প্রোডাকশন মেথড (Output or Production Method)
৩. ইনকাম(Income Method) বা আয় মেথড।
সারা বিশ্বে এক্সপেন্ডিচার বা খরচের হিসাব করে জিডিপি বের করার পদ্ধতি বেশি ব্যাবহার করা হয়। এতে একটা সুত্র আছে।GDP = C + G + I + NX
C মানে হল “কনসাম্পশন”। মানে একটি দেশে সারা দেশে আপনার আমার মত যত মানুষ আছে সবাই ভোগের জন্য যে খরচ করে সেটা। আপনি চাল, ডাল, ডাক্তার দেখানো, ছেলে মেয়ের শিক্ষার পেছনে ব্যয় থেকে শুরু করে সারা বছর যত খরচ করেছেন সেটা।
G মানে হল “Government Expenditures”। ব্যাক্তির হিসাব বাদ দিয়ে সরকার যে খরচ করে যেমন অবকাঠামো নির্মাণ, বেতন পেনশন দেয়া, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা সহ যত খরচ করে সব।
I মানে হল “Investment”। সারা দেশে ব্যাক্তিগত ভোগ বাদে বিভন্ন খাতে যত সরকারী বেসরকারি বিনিয়োগ হয় তার সমষ্টি।
আর সর্বশেষ NX হল “নেট রপ্তানি”। যদি রপ্তানি আমদানির থেকে বেশি হয় তবে বেশি অংশ যোগ হয় আর উল্টা হলে বিয়োগ হয়।
এখন কথা হল,জিডিপি দিয়ে আপনি যেটা করতে পারবেন সেটা হল একটি দেশে ঘটে যাওয়া আর্থিক লেনদেনের সাইজ জানতে পারবেন। আর এর মাধ্যমেই আপনি বুঝিবেন কোন দেশের অর্থনীতি কত বড়।অনেকেই আছেন যারা মনে করেন জিডিপি দিয়ে সব কিছু করে ফেলবেন। ভাই জিডিপি এর হিসাবের উপর এত প্রত্যাশা না করাই ভাল।
জিডিপি আপনাকে বলতে পারবে না একটি দেশের আর্থিক বৈষম্য কতটুকু, পরিবেশের ঝুকি কেমন অথবা জনগন সুখে আছে কি নেই। কথা হল আপনি একটি দেশের অর্থনীতির আকার জানার জন্য জিডিপির হিসাব নিচ্ছেন। এটা পরিবেশ ইনডেক্স না যে পরিবেশের ডাটা আপনাকে দিবে। এটা সাইকোলজির ডাটা না যে আপনার সুখ পরিমাপ করে দিবে। এটা অর্থনীতির আকারের হিসাব। এর কাছ থেকে এত কিছু প্রত্যাশা কেন করবেন?
ওগুলার জন্য আপনি গিনি কোইফিসিয়েন্ট আছে সেগুলার খোজ করুন, সার্ভে করে সুখ নির্নয় করুন। জিডিপিকে কেন দোষ দেন?
তবে নাক সিটকানো মানুষের রেফারেন্স হিসাবে কাজ করে অনেক অর্থনীতিবিদের মন্তব্য। অর্থনীতিবিদগণ যেটা বলে থাকেন, সেটা হল শুধু জিডিপি এর উপর এত গুরুত্ব না দিয়ে অন্য ইনডেক্স গুলিকেও গুরুত্ব দিতে। কারন জিডিপি আলু না যে সব রান্নায় যাবে। এটার যে তথ্য দেয়ার ক্ষমতা এটা সেটাই দিবে। ডিপ ইনসাইটের জন্য আপনি অন্য ইনডেক্স ফলো করুন।
জিডিপি এর গুরুত্ব না থাকলে আজ ও সারা বিশ্বে এত সমালোচনার পরো এর কোন বিকল্প কেউ দিতে পারেনি যেটা দিয়ে আপনি অর্থনীতির সাইজ নির্ধারণ করবেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে শুরু করে সব খানেই এটার উপর ভিত্তি করেই বহু ডিসিশন মেকিং করা হয়।
যদি একটি দেশের বাজার কত বড়, বিনিয়োগের ক্ষেত্র কত প্রসারিত সেটা বুঝতে চান তাও আপনার জিডিপি এর সহায়তা নিতেই হবে। শুধু শুধু এর সাথে পরিবেশ, বৈষম্য ইত্যাদি ইস্যু টেনে আনার মানে নেই। জিডিপি কম হবার কারনে এখন তারা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেছে। এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির পেছনে কারন তাহলে কি?
ধরুন, আপনি একটি জেলায় একটি মেডিকেল কলেজ করেছেন। এখন সেই মেডিকেলে প্রায় ১০০ জন প্রতি ব্যাচে পড়তেছে। এরকম পাঁচটি রানিং ব্যাচ নিয়ে মোট ৫০০ স্টুডেন্ট। প্রতি স্টুডেন্ট যদি বছরে ৫০০০০ টাকা ব্যয় করে থাকে তবে এক বছরে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২,৫০,০০,,০০০ বা আড়াই কোটি টাকা। যার হিসাবও জিডিপিতে যুক্ত হচ্ছে।
একটি দেশে অবকাঠামো, শিল্প, সহ সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়লে সেটা নানা ভাবে জিডিপি বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে মেগা প্রকল্পগুলিতে সরকারী বিনিয়োগ বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। আবার অবকাঠামো গড়ে উঠলে সেটাকে ঘিরে অনেক কিছু গড়ে উঠে। হয়ত কোন জেলায় একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করা হল, তাহলে সেটাকে ঘিরে অনেক দোকানপাট এমনকি একটি নতুন বাজারও সৃষ্টি হতে পারে। ফলে জিডিপি বেড়ে যায়। একটি ইকোনমিক জোন করলে সেটাকে ঘিরে একটি নতুন শহর সৃষ্টি হয়। সেই প্রভাব ও জিডিপি তে পড়ে।
তবে জিডিপি তে সব অর্থের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ ভাবে পড়ে না। যেমন মাদক নিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ৫০০০০ কোটি টাকার বেশি বাজার রয়েছে। কিন্তু এটা প্রত্যক্ষ ভাবে জিডিপিতে না আসলেও এটা থেকে আয় করা মানুষের বসত বাড়ি, লাইফ স্টাইলের ব্যয় জিডিপিতে প্রভাব ফেলে।দূর্নীতি, ঘুষের মত বিভিন্ন ভাবে কালো টাকা এভাবে ইনডিরেক্টলি জিডিপিতে প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের ২০২০ সালের এস্টিমেট অনুযায়ী জিডিপি এখন ৩৪৭ বিলিয়ন ডলার। হয়ত ২০২১ সালে এটি $৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেশি হলে ধরে নেয়া হয় সেই দেশের ইকোনমিক এক্টিভিটি প্রতিবছর দ্রুত গতিতে বাড়ছে। আর যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করে তবে বুঝতে হবে ইকোনমিক এক্টিভিটি কমে গেছে।
এর ফলে হয়ত অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। জব থেকে ছাটাই করা হচ্ছে। বাজারে বিক্রি কমে গিয়েছে।জিডিপি যে কমে যাবে সেটা বুঝা গিয়েছিল ওদের অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদন কমে যাওয়া, চাকুরী হারানো, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার লক্ষন দেখে। তাই জিডিপি দিয়ে আপনি পরিবেশ, সুখ এগুলা না বুঝলেও একটি দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ভাল ধারনা পাওয়া যায়।আর একারনেই জিডিপি আজো এত গুরুতপূর্ন! লেখাটির সুত্রঃ Defence Research Forum- DefRes
Leave a Reply